বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, অনেক ত্যাগ এবং চেষ্টার বিনিময়ে যে পরিবেশ এসেছে, এই পরিবেশ তিনটা ম্যান্ডেটরি জিনিস দাবি করছে। দৃশ্যমান গ্রহণযোগ্য মৌলিক সংস্কার। যারা নিহত এবং আহত হয়েছে এই খুনের দায় যাদের, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃশ্যমান বিচার এই জাতিকে দেখাতে হবে। যাতে জাতির আস্থা ফিরে আসে, যে খুনিদের বিচার হবে, অপরাধীদের বিচার আমরা পাবো। এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরকে সম্মান করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির সামনে বারবার বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে ইলেকশন অনুষ্ঠিত হবে। আনুষাঙ্গিক প্রস্তুতি ও সংস্কার এবং বিচারের জন্য আমরা মনে করি সময়টা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই সময়ের সীমা যেন অতিক্রম করে না যায়। সেই ব্যাপারে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবো। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক দলগুলা যত তাড়াতাড়ি এবং যত আন্তরিকভাবে সংস্কারের সহযোগিতা করবে, তত তাড়াতাড়ি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে।

বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানী ঢাকার গুলশানস্থ হোটেল ওয়েস্টিনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াত নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, নায়েবে আমীর সাবেক এমপি মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আজাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, এডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল ও এডভোকেট এহসানুল মাহবুবু জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মোঃ ইজ্জত উল্লাহ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মো. সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।

আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘সাউথ এশিয়া সম্পর্ক বিষয়ক ডেলিগেশন’-এর সম্মানিত চেয়ারম্যান মি. শেরবান-ডিমিত্রি স্তুরজা-এর আমন্ত্রণে গত ৭ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ইউরোপ এবং ১১ ও ১২ এপ্রিল যুক্তরাজ্য সফর করে। জামায়াতের এ প্রতিনিধি দলে ছিলেন সংগঠনের নায়েবে আমীর সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, জামায়াতের ইউরোপের মুখপাত্র ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা, আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাহবুবুল আলম এবং আমীরে জামায়াতের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মাহমুদুল হাসান চৌধুরী। সফর শেষে দেশে ফিরে সফর বিষয়ে এ সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, এ সফরে আমাদের লক্ষ্য ছিল সভ্য এবং আধুনিক এই বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র ইউরোপের সাথে আমাদের দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করা। নতুন বাংলাদেশের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া এবং অনন্য একটা উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য বিরামহীন চেষ্টা চালানো। এরই অংশ হিসেবে এই সফর ছিল আমাদের জন্য নয়, আমাদের জাতির জন্য প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নিঃসন্দেহে আমরা সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করি না। আমরা একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক, ইসলামী সংগঠন। আমাদের রাজনীতির মূল উপপাদ্যই হচ্ছে জনগণের কল্যাণ, দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সাস্টেইনেবিলিটি। এটাকে সামনে রেখেই আমাদের এই সফর। এই সফরে পর্যায়ক্রমে আমরা ছয়টি কর্তৃপক্ষের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মিলিত হয়েছি। প্রতিটি মিটিং এক ঘন্টা থেকে পৌনে দুই ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেই বৈঠকগুলোতে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি।

ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, প্রথম মিটিংটি হয়েছিল ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের অনারেবল ফরেন পলিসি এডভাইজার মিস ভেরোনিকা মুসিলেনবার সাথে। দ্বিতীয় বৈঠকটি আমাদের অনুষ্ঠিত হয় অনারেবল বাইল্যাটারেল এফেয়ার্স ফর এশিয়া এন্ড ওশিয়ান কিংডম অফ বেলজিয়াম গর্ভমেন্ট এর প্রতিনিধির সাথে। তিনি হচ্ছেন ফ্রাঙ্কুইস দিল্হি। তিনি আমাদের দেশ ইতিপূর্বে চার চারবার সফর করেছেন। দুইবার তিনি রোহিঙ্গা শিবির সফর করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং বেলজিয়ামের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের তৃতীয় মিটিং ছিল মিস্টার মাইকেল সটার, যিনি অনারেবল ডিরেক্টর ডিরেক্টরেট জেনারেল ফর মাইগ্রেশন এন্ড হোম এফেয়ার্স ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। তাদের একটা বিগ কনসার্ন মাইগ্রেন্টস নিয়ে। মাইগ্রেন্টসদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিভিন্ন দেশ থেকে তারা বৈধ পথে সেখানে যান না এবং আশ্রয় নেন না। এটি তাদের জন্য একটা উদ্বেগের বিষয়। নিঃসন্দেহে যে দেশ থেকে তারাই মাইগ্রেশন করেন, সেই দেশের জন্য এটা একটা কনসার্নের বিষয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এরপরের মিটিংটি ছিল ইউরোপিয়ান কমিশন এর সাথে। সেখানে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মিস্টার চার্লস হুইটলি। পরের মিটিংটি ছিল অনারেবল ডিরেক্টর বেলজিয়াম ইকোনমিক মিশনস এন্ড স্টেট ভিজিটস এফেয়ারস রোজ ডন মিস ডনকের সাথে। তার সাথে মিটিংটি ছিল আমাদের শেষ মিটিং। এর বাইরেও আমরা কিছু রাইটস অর্গানাইজেশন এর সাথে মিলিত হয়েছি। আমাদের দেশের অবস্থা, লেবার রাইটস, হিউম্যান রাইটস নিয়ে তাদের সাথে কথা হয়েছে। যেহেতু এগুলো ফরমাল কোন মিটিং ছিল না। সেইজন্য আমরা এখানে উল্লেখ করছি না।

মিটিং এ কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলোতে অনেকগুলো বিষয় সামনে উঠে এসেছে। এর মাঝে প্রথম বিষয়টাই ছিলম গণতন্ত্রকে সংহত করা এবং টেকসই করা। এই ব্যাপারে আমাদের বন্ধু প্রতিম দেশ এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টনারস যারা আছেন, তারা তাদের দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদেরকে কি সহযোগিতা করতে পারেন। ইউরোপের ২৬টি দেশ মিলে বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। একসময় এটি ২৭ টি ছিল ইউকে এখান থেকে এক্সিট নেওয়ার পরে এখন ২৬ টি দেশ তার সদস্য রাষ্ট্র। অধিকাংশ রাষ্ট্রই আমাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, এডুকেশন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং লেবার এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম নিয়ে আমাদের সাথে তারা জড়িত। এই ক্ষেত্রে আমরা তাদের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে আমরা সহযোগিতা তাদের কাছে চেয়েছি। এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলা দেশ পিআর সিস্টেমে নির্বাচন করে থাকেন।

নির্বাচন নিয়ে আলোচনার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচনের সেই সিস্টেমগুলো নিয়ে তাদের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাগুলো আমরা জানার সুযোগ পেয়েছি। তার কোন মেরিট থাকলে সে মেরিটগুলো কি কি আছে আর যদি কোন ডিমেরিটস থাকে তাইলে সেগুলো কি। আমরা সব বুঝার চেষ্টা করেছি এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের দেশ ও জাতি যাতে লাভবান হতে পারে, আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য হতে পারে, সেই জন্য আমরা কথাবার্তা বলেছি। পাশাপাশি তাদের দেশগুলো কিভাবে ন্যাশনাল ইউনিটিকে দিন দিন শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেল, সে বিষয়গুলো আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি।

তিনি বলেন, একটা দেশের স্থিতিশীলতা, তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অবশ্যই ফান্ডামেন্টাল কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দিতেই হবে। এর মাঝে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের জায়গায় দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে এক থাকা। এই এক থাকার বীজতলা তারা কিভাবে তৈরি করেছেন। আমরা তাদের কাছ থেকে এগুলো বিস্তারিত জেনেছি। এই কন্টেক্সটে তারা আমাদের দেশের অবস্থাও জানতে চেয়েছেন। অবভিয়াসলি সেগুলো আমরা তাদের সাথে শেয়ার করেছি।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইকোনমিক কোঅপারেশনের ব্যাপারে তাদের সাথে আমাদের বিস্তারিত কথা হয়েছে। আমরা সবাই জানি আমাদের প্রধান রপ্তানি সেক্টরটাই হচ্ছে গার্মেন্ট সেক্টর। ইউরোপ হচ্ছে, তার সবচাইতে বড় বায়ার। এখানে তারা কিছু কমপ্লায়েন্স চায়। আমাদের লেবারদের কিছু রাইট প্রটেকশন তারা চায়। আমরা তাদেরকে বলেছি, আমরা বিশ্বাস করি শিল্প বাঁচলে শ্রমিকরা বাঁচবে। আবার শ্রমিকরা বাঁচলে শিল্প বাঁচবে। এই স্লোগানের ভিত্তিতে কেবলমাত্র টেকসই শিল্প ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব। এর পাশাপাশি আমরা তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছি। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ, আমাদের বিপুল সংখ্যক জনশক্তি রয়েছে। তাদেরকে আমরা আহ্বান করেছি, তারা যেন আমাদের দেশে এসে ইনভেস্ট করে। বিশ্বের ১৫ টা শক্তিশালী ইকোনমি দেশের মধ্যে সাতটাই কিন্তু ইউরোপে রয়েছে। আমরা বলেছি, আপনারা যদি আসেন তাহলে এখানে আমরা উভয় লাভবান হবো। আপনারা ব্যবসায়ী দিক থেকে লাভবান হবেন, এই কারণে যে আমাদের দেশে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক পাওয়া খুবই সহজ। এটা তুলনামূলকভাবে লেস এক্সপেন্সিভ। সুতরাং আপনাদের উৎপাদন খরচ কম হবে। আপনারা আসলে আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আপনাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যখন কর্মপরিবেশ আপনারা সৃষ্টি করবেন। তাতে আরো দুটো লাভ হবে, আমাদের ম্যানপাওয়ারের স্কিল ডেভেলপমেন্ট হবে এবং আমাদের ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরগুলো আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানার এবং নেওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে শিল্পে সুস্থ অবস্থা ফিরে আসবে। সুস্থ অবস্থা যখন ফিরে আসবে, তখন অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে যাবে। শিল্পে যদি অস্থিরতা থাকে সে শিল্প কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। এইজন্য শিল্পের স্থিতিশীলতা একটা বড় শর্ত আমরা এই সকল বিষয় তাদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করেছি, এমনকি আমরা এটাও বলেছি, আমাদের দেশে কিছু স্পেশালাইজড ইকোনমিক জোন আছে। আমরা আমাদের সরকারকে সুপারিশ করবো, তারা যেন ইউরোপের জন্য একটা স্পেশালাইজড ইকোনমিক জোন করে দেন। এই ক্ষেত্রে কিছু ট্যাক্স টারিফের বিষয় আছে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সেটেল করা সম্ভব। আমরা আশা করছি, আমাদের সরকার উভয় দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে নিবেন। তারা এখানে ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছেন। আমরা এটাকে ইতিবাচকভাবে নেবো।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একজন রাষ্ট্রদূত আছেন কিন্তু সবগুলা দেশের এম্বেসি আমাদের দেশে নেই। এই মিশনগুলা থাকলে আমাদের কমিউনিকেশন আপনাদের সাথে খুব দ্রুততর হবে। এগুলা না থাকার কারণে আজকে আমরা ইউরোপের রাজধানী বেলজিয়াম ব্রাসেলসে এসেছি কিন্তু ভিসা নিয়ে আসতে হয়েছে সুইডেনের। বেলজিয়াম এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাব যেহেতু সেখানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কমিশন এবং কাউন্সিলের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত তো সেই কারণে আমরা তাদেরকে বিশেষ করে বেলজিয়াম অথরিটিকে আমরা অনুরোধ করেছি আমাদের দেশে দূতাবাস খোলা হয়।

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশের একটা বিশাল ক্রাইসিস নিয়ে তাদের সাথে শেয়ার করেছি। যেটার পার্টনার তারাও। এটি হচ্ছে ১.৬ মিলিয়ন রোহিঙ্গা যারা আমাদের বুকের উপরে আছেন। তারাও মানুষ আমাদের মত। আমাদের মত তাদের একটা ঠিকানা ছিল, তারা সেখানে খেয়ে বেঁচে চলছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত অমানবিকভাবে তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। খুন করা হয়েছে, মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। তারপরে তাদেরকে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছি মানবিক কারণে। কিন্তু বাংলাদেশ এমনিতেই একটা বিপুল জনসংখ্যার দেশ। সেই দেশের পক্ষে এই ক্রাইসিস মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এখানে পার্টনার হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করে। আমরা বলেছি, এটা কোন সমাধান নয়। তাদেরকে কিছু ফুড সাপ্লাই দিলাম, কিছু ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করে দিলাম, অতি নগণ্য কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলাম আর টেম্পোরারি শেডের নিচে তাদেরকে গাদাগাদি করে আশ্রয় দিলাম, এটা অনেকটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মত এটি মানবিক জীবন নয়, এ জীবন অমানবিক এর সমাধান হচ্ছে তাদেরকে তাদের দেশের সম্মান এবং সিকিউরিটির সাথে ফিরিয়ে দেওয়া। এটি বাংলাদেশ একা পারবে না। এখানে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির সহযোগিতা লাগবে। বড় মাত্রার আমরা তাদেরকে বলেছি যে, উদ্যোগী হয়ে আপনারা ভূমিকা নিবেন। আমরা আশা করি, জাতিসংঘ এবং বিশ্বের বিবেকবান দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়ান।

বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে জানতে চেয়েছেন, নির্বাচন কিভাবে হবে কখন হবে। আমরা বলেছি, অনেক ত্যাগ এবং চেষ্টার বিনিময়ে যে পরিবেশ এসেছে, এই পরিবেশ তিনটা ম্যান্ডেটরি জিনিস দাবি করছে। (এক) দৃশ্যমান গ্রহণযোগ্য মৌলিক সংস্কার। এ বিষয়গুলো আমরা ইতোমধ্যে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছি। সংশ্লিষ্ট কমিশনে জমা দিয়েছি। আমরা বলেছি, এই সংস্কারগুলো শেষ না করে যে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচন গণতন্ত্রের কোন ভিত্তি রচনা করতে পারবে না। বরঞ্চ অতীতের নির্বাচন যে নির্বাচনগুলো দেশ এবং জাতির কাছে বিশ্বের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেরকম হয়তোবা আরেকটি খারাপ নির্বাচন হবে। আমরা ওই নির্বাচন চাই না। হাজার প্রাণের বিনিময়ে হাজারো হাজার মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে আহত হওয়ার বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তনে অবশ্যই সংস্কার সাধন করতে হবে। সংস্কারের অংশীজন প্রধান অংশীজন হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো। এই রাজনৈতিক দলগুলা যত তাড়াতাড়ি এবং যত আন্তরিকভাবে সংস্কারের সহযোগিতা করবে, তত তাড়াতাড়ি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে। এই সংস্কারে যদি সহযোগিতার ঘাটতি থাকে কিংবা সংস্কার যদি না হয়, তাহলে দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা হোক, সে দাবি পূরণ না হওয়ার কারণে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং তার দায় রাজনৈতিক দলগুলাকে নিতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলাকে বাস্তবতার জায়গায় এসে অবশ্যই জনপ্রত্যাশা পূরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এখানে সংস্কারের সহযোগিতা করতে হবে।

(দুই) যেটা পূরণ করা উচিত এটি হচ্ছে, যারা নিহত এবং আহত হয়েছে এই খুনের দায় যাদের, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃশ্যমান বিচার এই জাতিকে দেখাতে হবে। যাতে জাতির আস্থা ফিরে আসে, যে খুনিদের বিচার হবে, অপরাধীদের বিচার আমরা পাবো। শহীদ পরিবারগুলো যাতে মিনিমাম কনসালেশন পায়, তাদের আত্মা যাতে প্রশান্তি পায় যে, হ্যাঁ আপনজন ফিরে আসবে না কিন্তু এদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সেই ন্যায়বিচারটি দেখতে চাচ্ছি।

(তিন) যেটা হতেই হবে এটি হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরকে সম্মান করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমি জিতে গেলে নির্বাচন সুষ্ঠু হেরে গেলে সুষ্ঠু নয়, এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে হ্যাঁ, সেই নির্বাচনটা এমন হতে হবে যে, সেই নির্বাচন নিয়ে যাতে সহজে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। এই দুইটাই নিশ্চিত করা লাগবে। এইজন্য এখানে অনেক ডায়ালগের প্রয়োজন, অনেক এঙ্গেজমেন্টের প্রয়োজন, এটি সরকারের তরফ থেকে হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলার নিজস্ব উদ্যোগে হতে পারে সিভিল সোসাইটিরও দেশ এবং রাষ্ট্রকে দেওয়ার অনেক দায়িত্ব আছে সেই জায়গা থেকেও হতে পারে। এটা যখন মাল্টিপল জায়গা থেকে হবে। তখন তার একটা পরিবেশ তৈরি হবে। আমরা এই বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করেছি।

নির্বাচনের সময় নিয়ে তিনি বলেন, তারা নির্বাচনের সময় জানতে চেয়েছে। আমরা বলেছি প্রধান উপদেষ্টা তিনি জাতির সামনে বারবার বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে ইলেকশন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা এই সময়টাকে আনুষাঙ্গিক প্রস্তুতির জন্যে, সংস্কারের জন্য, বিচারের জন্য আমরা মনে করি যে, এই সময়টা গ্রহণযোগ্য কিন্তু এই সময়ের সীমা যেন অতিক্রম করে না যায়। সেই ব্যাপারে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবো। গতকাল আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির সাথে আমরা সাক্ষাৎ করেছি, বের হওয়ার পরে আপনারা সাংবাদিক বন্ধুরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন আমি বলেছি যে, এই নির্বাচন হতে পারে রোজা শুরু হওয়ার আগে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। আমি আবারও বলছি এটা তখনই হতে পারে। যখন এই শর্তগুলো পূরণ হবে। এই শর্ত পূরণ ছাড়া কিন্তু ওই মার্চ, ফেব্রুয়ারি কোন কিছুই ঠিক থাকবে কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। এজন্য আমরা সিনসিয়ারলি যারা চাচ্ছি, দেশে জনগণের গণতন্ত্র ফিরে আসুক।

তিনি বলেন, তাদের সকলকে আন্তরিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রস্তুত সকল ধরনের সহযোগিতার জন্য। আমাদের দল প্রস্তুত আমরা আমাদের বন্ধু সংগঠন সবাইকে আহ্বান জানাবো, আসুন সবাই আমরা এগিয়ে যাই। আমাদের কর্মকা-ই প্রমাণ করবে যে আমরা কতটা আন্তরিক। এই বিষয়ে জনগণ তখন দেখতে পারবে, বিবেচনা করবে আর জনগণের ইচ্ছার উপর আমরা বিষয়টাকে ছেড়ে দেই। আগামী নির্বাচনে কাকে তারা সিলেক্ট করবে। তারা অতীত দেখবে, দলগুলার ম্যানিফেস্টো দেখবে, বর্তমান কর্মকা- বিবেচনায় নিবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আমীরে জামায়াত বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম যে, ইউরোপ মানে বেলজিয়ামের সফর শেষ করে আমরা ইউকেতে গিয়েছিলাম তিন দিনের জন্য। আপনারা জানেন বাংলাদেশে ফেসিস্ট আমলে রাজনৈতিক সকল দলই ছিল নির্যাতিত এবং সারা জনগণ ছিল নির্যাতিত। নির্যাতিত দল হিসেবে প্রথম আঘাতটা আমাদের উপরেই আসে। শেষ আঘাতটাও আমাদের উপরে আসে। প্রথমে আমাদের নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে। ব্রিটেনের একটা আদালত এ সংক্রান্ত রায়ে বলেছে, ইট ওয়াজ এ জেনোসাইড অফ দা জাস্টিস। শেষ আঘাতটা ছিল আমাদেরকে নিষিদ্ধ করা। আমরা মজলুম আমরা আমাদের ১১ জন নেতা হারিয়েছি। অসংখ্য সাথী হারিয়েছি। অসংখ্য ভাইবোন পঙ্গু হয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তারাও প্রচুর সাথী এবং সহকর্মীকে হারিয়েছে। আমরা যেমন আয়নাঘরের শিকার হয়েছি। তারাও হয়েছেন, আমরা যেমন মামলা খেটেছি, জেলে গিয়েছি তারাও গিয়েছেন, লাখে লাখে হাজারে হাজারে না আমরা উভয় দল ব্যক্তি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াও জুলুমের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি একদিকে মজলুম আরেকদিকে অসুস্থ। ইউরোপ সফরে গিয়েছি ইউকেতে তার বাসায় গিয়েছি। তারা আমাদেরকে অতি ভালোবাসা এবং সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছেন। আমাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল উনাকে দেখা। কিন্তু যেহেতু তিনি অবস্থান করছেন, তার বড় সন্তান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বাসায় সেই কারণে তিনিও থাকবেন এটি স্বাভাবিক। তিনি ছিলেন দুইজন বাংলাদেশী মানুষ চা খেতে গেলে একজনের সাথে আরেকজনের কোন পরিচয় নাই শুরু করে দেয় আমাদের দেশের রাজনীতির কথা। আর আমরা দুই দলের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ এক জায়গায় বসবার রাজনীতির কোন কথা হবে না এটা কি বাস্তব এটা বাস্তব না। কথা তো হয়েছে কিন্তু আমরা সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়ে কথা বলিনি। কখন নির্বাচন হবে কিভাবে নির্বাচন হবে বিচার প্রক্রিয়া কিভাবে হবে, না হবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা সাধারণ আলোচনা করেছি। ওইটার ডিসিসিভ কোন ডিসকাশন ছিল না। আর যেটা বলেছেন রাজনীতিতে দুই দলের বিরোধ যদি আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনের দিকে তাকান তাইলে এটা কোন বিরোধী না। সেখানে বাগযুদ্ধ তো হয়েছে। কিন্তু ইলেকশন হয়ে যাওয়ার পরে হ্যান্ডশেক। একদল চলে গেছে সরকারে আরেকদল বসে গেছে বিরোধী দলে। এখন তারা মিলেমিশে তাদের দেশ চালাবে এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতিতে আমরা চাই মতপার্থক্য থাকুক। না থাকলে রাজনীতিবিদরা অন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ চোখ খুলে দেওয়ার জন্যই প্রয়োজন মতপার্থক্য কিন্তু এও আমরা প্রত্যাশা করি যে, এটা যেন মতবিরোধের রূপ না নেয়। যেহেতু এটা কোন ফরমাল মিটিং ছিল না এইজন্য বিএনপিও দেয় নাই আমরাও দেওয়ার কোন দরকার মনে করি নি।

অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি হচ্ছে সংস্কার এবং বিচার নিয়ে যে, আমরা ফেব্রুয়ারি মার্চের মধ্যে আদালতকে বাধ্য করতে পারি কিনা এই বিচার সম্পন্ন করতে। না আমরা সম্পন্ন করার কথা বলিনি, আমরা বলেছি যে, কিছু বিচার হতে হবে দৃশ্যমান যাতে জাতির মনে আস্থা তৈরি হয়। আমরা আস্থা রাখতে চাই এবং আমরা মনে করি যে, সরকারে যারা আসবে তারা জনগণের সমর্থন নিয়ে আসবে। জনগণের পালস বুঝে আসবে। জনগণও তাদেরকে বুঝে গ্রহণ করবে। আমরা বিচারকে বাধ্য করে দিতে পারি না। আমরা বলে দিতে পারি না যে অত তারিখের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। যদি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করে ইলেকশন হয়, তাতে আমার আপত্তি থাকবে কেন। আমার তো আপত্তি থাকার কথা না। আবার যদি এর জন্য আরেকটু সময়ের প্রয়োজন হয়, আমরা সাড়ে বছর ১৬ বছর অপেক্ষা করতে পেরেছি। আরো এক দুই মাস অপেক্ষা করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।

তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে কোন কথা হয়েছে কিনা। আমরা তাদেরকে বলেছি যে, আমাদের দেশে কেবলমাত্র একটা গণহত্যা হয়ে গেছে। শহীদের মা শিশুরা এখনো কান্নাকাটি করছে, স্ত্রীরা কান্নাকাটি করছে, আহতরা কেউ কেউ এখনো হাসপাতালের বেডে আছে। আমরা জাতি হিসেবে তাদেরকে আমাদের যে করণীয় সেইটা পুরাপুরি করে উঠতে পারিনি। জুলাই আগস্ট এই সময়টা সরকার কার্যত গোটা জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এই আন্দোলন কোন একক দলের বা পক্ষের ছিল না। এটা ছিল জনতার আন্দোলন। নেতৃত্বে ছিল আমাদের যুবক-যুবতীরা। কিন্তু আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল, সারা দেশের জনগণ। তিনি বলেন, তারা তো অপার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারা একটা না তিনটা নির্বাচন তাদের অধীনে করেছেন। সেই নির্বাচনগুলোকে নির্বাচন রাখলেন না কেন? তারা তো নির্বাচনের জান কবজ করেছে, এমনকি জনগণ তো বলে যে, তাদের ভোটাররা তাদেরকে যারা সমর্থন করে ওরাও নির্বাচনের প্রতি এতটা আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল তারাও ভোট দিতে যায়নি। ফ্যাক্ট তা সেইরকম একটা দলকে এই মুহূর্তেই বাংলাদেশের জনগণ গ্রহণ করবে কিনা এবং আওয়ামী লীগও তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করেছে কিনা সেটা বিশাল প্রশ্ন। এ কথা বলার পরে তারা আর কিছু বলেননি তারা আর পাল্টা জিজ্ঞেস করেননি এইটা কি ওইটা কি এখানেই তারা থেমে গেছে।

অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুনের পরেও যদি নির্বাচন গড়িয়ে যায়, সেক্ষেত্রে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হবে কিনা, আমরা এরকম কিছু এখনই প্রেডিক্ট করতে চাই না। বরঞ্চ আমরা ভালোটাই প্রত্যাশা করি।