খুলনা-২ আসন সোনাডাঙ্গা ও খুলনা সদর থানা নিয়ে গঠিত। জাতীয় সংসদের ১০০ নম্বর আসন খুলনা-২। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় জোরেসোরে নেমেছেন। তারা সকাল থেকে রাত অবধি লিফলেট বিতরণ, সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। বিএনপি তিন নেতা ও জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য খুলনা মহানগরী সেক্রেটারি এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল ছাড়া মাঠে আর কাউকে দেখা মিলছে না।

খুলনা জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য মতে, এ আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৭৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯২১, নারী ভোটার ১ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৬ ও হিজড়া ভোটার ৭ জন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মাত্র ৪ বার এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। বিগত দিনে এ আসনে বিএনপিরই প্রাধান্য ছিল বেশি।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, খুলনা-২ আসনকে ভিভিআইপি আসন বলা হয়ে থাকে। কারণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেছিলেন। এছাড়া সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অথবা ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান এবার এ আসনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন।

এ আসন থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মহানগর বিএনপির সভাপতি এডভোকেট এস এম শফিকুল আলম মনা ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন। এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও খুলনা মহানগরী সেক্রেটারি এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহানগর সভাপতি মাওলানা মুফতি আমানুল্লাহ ও খেলাফত মজলিসের খুলনা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মো. শহীদুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল সকাল থেকে রাত অবধি লিফলেট বিতরণ, সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদের খুলনা মহানগর সহ-সভাপতি ফয়সাল শেখ এর তৎপরতা রয়েছে। তবে এ আসনটিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এনসিপি) ও জাতীয় পার্টির কোন নির্বাচনী তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

ঘরে-বাইরে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় পর ২০২১ সালে খুলনা বিএনপি থেকে বাদ পড়লেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শেষে তার এমন পরিণতি মানতে পারেননি বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তাদের মন্তব্য, নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও খুলনা বিএনপি একে অপরের পরিপূরক। যে কারণে তারা মঞ্জুকে খুলনা-২ আসনের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চেয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিগত দিনে খুলনা-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। নির্বাচনী এলাকায় সব সময় বিভিন্ন সামাজিক ও দলীয় অনুষ্ঠানে সক্রিয় রয়েছেন তিনি।

মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, আমি নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্র¯‘ত। তার দল চাচ্ছে ক্লিন ইমেজের জনপ্রিয় মানুষ। আন্দোলন সংগ্রামে জেল-জুলুম, নির্যাতনের শিকার এমন মানুষকে মূল্যায়ন করতে। এক্ষেত্রে আমি একজন পরীক্ষিত প্রার্থী। ২০০৯ সালে নির্বাচনে সারাদেশে যে ৩০ জন বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছিল তার মধ্যে আমি একজন। এছাড়া মেয়র ও এমপি নির্বাচনে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। ভোট ডাকাতি করে আমাকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন অপশক্তির সঙ্গে আপস করিনি। শহীদ জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে স্বৈরাচারী সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাজপথে ছিলাম। মঞ্জু বলেন, দুঃসময়ের দিনগুলোতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, ত্যাগ ও শ্রমের কারণে আমি আশাবাদী, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।

খুলনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ছিলেন এডভোকেট শফিকুল আলম মনা। দীর্ঘ দিন তিনি রাজপথে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামের সারথী হিসেবে কাজ করছেন। হয়েছেন মহানগর বিএনপির সভাপতি। আওয়ামী সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নে সাংগঠনিকভাবে দলের হাল ধরেন খুলনার এ শীর্ষ নেতা।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও খুলনা মহানগর সভাপতি এডভোকেট এস এম শফিকুল আলম মনা বলেন, স্বাভাবিকভাবেই আমি শহরে বাস করি এবং মহানগরী সভাপতি, তাই নির্বাচন করলে শহরের বাইরে যেতে চাই না। সর্বোপরি দল যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই আমি মেনে নেব। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

ছাত্রদল ও যুবদলের মহানগর সভাপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন খুলনা মহানগর বিএনপির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলেনে ১০৮টি মামলার আসামি তিনি। ৫ আগস্টের পর এসব মামলার প্রায় অর্ধেক থেকে খালাস পেয়েছেন। তুহিনের অনুসারীরা খুলনা-২ আসনের বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তার প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেন, আমি ৪৩ বছর ধরে রাজনীতি করি। এ শহরের অলি গলি রাস্তা-ঘাটসহ মানুষকে আমি চিনি। এই শহরের সব কিছুর সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক আছে। অন্তত ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানের আমি আজীবন সদস্য । শহরের প্রতিটি ভালো কাজের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল। আমার জন্ম এই শহরে। লেখাপড়া করেছি এই শহরে। মারা গেলে হয়তো এই শহরে বাবা-মার পাশে কবর দেওয়া হবে। ছাত্র রাজনীতি করেছি এই শহরে। আন্দোলন সংগ্রাম বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এখানে আসা। তুহিন বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী আন্দোলেনে ১০৮টি মামলার আসামি আমি। অসংখ্যবার কারাগারে গেছি। হাতের কর গুণে বলতে পারবো না কতবার কারাগারে গেছি। খুলনা-২ আসনে আমি প্রার্থী।

খুলনা-২ আসনে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য ও মহানগরী সেক্রেটারি এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলালকে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে জামায়াত। কেসিসি ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগরী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ছিলেন তিনি। পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে তার বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা করা হয়। ৩ বার জেলে গেছেন। ৩২টি মামলার মধ্যে বেশ কিছু মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও মহানগরী সেক্রেটারি এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল বলেন, নির্বাচনে দুই ধরনের কাজ করতে হয়। নমিনেশন দেওয়ার পরে এক ধরনের কাজ। তফসিল ঘোষণা করার পরে আর এক ধরনের কাজ। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হলো গণসংযোগ করা। ঘোষণার পর ১৬টি ওয়ার্ডে আমরা নির্বাচনী গণসংযোগ করেছি। মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে যাচ্ছি, সাংগঠনিক কার্যক্রম মজবুত করা এবং সংগঠনকে গতিশীল করছি। এ জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নির্বাচনী লিফলেট, উঠান বৈঠক, ভোটার সমাবেশ, ভোট কেন্দ্র প্রতিনিধি সমাবেশ ও গণসংযোগ করছি জোরেসোরে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহানগরী সভাপতি মাওলানা মুফতি আমানুল্লাহ বলেন, আমরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক প্র¯‘তি রয়েছে। তবে কেন্দ্র থেকে এখনো মাঠে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। নির্দেশ পেলেই মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বো। নির্বাচনের মাঠে বিএনপি ও জামায়াত সরব থাকলেও এনসিবির কোনো নির্বাচনী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

জাতীয় নাগরিক কমিটি খুলনার সংগঠক আহম্মদ হামীম রাহাত বলেন, আসনভিত্তিক দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। এ বিষয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর খুলনা-২ আসনে আওয়ামী লীগ ১৯৭৩, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জয় পেয়েছে। এরমধ্যে ১৯৭৩ সাল বাদ দিলে বাকি তিনবারই বিতর্কিত নির্বাচন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের শেখ আব্দুর রহমান, ১৯৭৯ সালে বিএনপির শেখ সালেহ মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মো. মহসিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ রাজ্জাক আলী (মৃত) বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে জয়ী হওয়ার পর তাকে জাতীয় সংসদের স্পিকার করেছিলো বিএনপি সরকার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করে বিজয়ী হন। এরপর তার ছেড়ে দেওয়া আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মহানগর বিএনপির তৎকালীন মহানগর আহবায়ক আলী আসগর লবী। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু ৯০ হাজার ৯৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান পেয়েছিলেন ৮৯ হাজার ২৮০ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ১ হাজার ৬৭০। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান মিজান। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এ আসনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাতিজা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল বিজয়ী হন।