খুলনা ব্যুরো : ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সাথে মিল রেখেই শুরু হয়েছিল খুলনার বহুলালোচিত সেই শেখ বাড়ি ভাংচুর। বুধবার দিবাগত রাত নয়টা থেকেই হাতুড়ি, হেমারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে ভাংচুর শুরু করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা। প্রথমেই খুলে ফেলা হয় মূল গেটের টিনের বেড়া। যেটি ৪/৫ আগষ্টের ভাংচুরের মাস দুয়েক পর কে বা কারা দিয়ে আটকে দিয়েছিল। যাতে শেখ বাড়ির মধ্যে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। এরপর মুহূর্তের মধ্যেই শেখবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে ছাত্রজনতা। শুরু হয় ভাংচুর। কিছুক্ষণ পরই খুলনা সিটি কর্পোরেশনের একটি এস্কেবেটর। দেওয়ালসহ গেটের অংশবিশেষ ভাঙ্গা হয় সেটি দিয়ে। এর কিছুক্ষণ পর কেসিসির আরও একটি বুলডোজার এসে ভাংচুর করা হয়। গভীর রাত পর্যন্ত ভাংচুর চলে। এরই মধ্যে বাড়ির ছাদে এক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দেয়।

কিন্তু তা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। সেখানে ধীরে ধীরে মানুষ জড়ো হতে থাকে। আশপাশ এলাকার মানুষের পাশাপাশি উৎসুক পথচারীরাও সেখানে ভিড় জমাতে থাকে। এভাবেই খুলনার শেখ বাড়িসহ নগরীর আরও দু’জন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ভাংচুর হয় ওই রাতে। এছাড়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও ভাংচুরের চেষ্টা চলে রাতভর। কিন্তু ভাংতে না পেরে কিছুটা বিকৃত করা হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার ভাংচুর করা হয় দৌলতপুরস্থ সরকারি বিএল কলেজের বিজ্ঞান ভবনের সামনের মুজিব ম্যুরাল। সব মিলিয়ে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত শেখ বাড়িসহ খুলনার সর্বমোট পাঁচটি স্থানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

তিনটি বাড়ির কোনটিতে নেই দৃশ্যমান হোল্ডিং নম্বর । নগরীর আলোচিত শেখ বাড়িটি শের-এ-বাংলা রোডে অবস্থিত। ছিল সুরম্য অট্টালিকা, দৃষ্টিনন্দন গেট। কেউ ব্যাগ নিয়েও ঢুকতে পারতো না ওই বাড়িতে। এ চিত্র ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের আগের। ওই বাড়ির দক্ষিণ পাশের বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর ৩৬২। উত্তর পাশে ছোট্ট গলি গেছে বাড়িটির শেষ প্রান্তে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে। যার উত্তরের একটি দোকানের হোল্ডিং নম্বর দেখা গেছে ৩৯১। কিন্তু আলোচিত বাড়ির কোন দৃশ্যমান হোল্ডিং নম্বর নেই। তবে বিগত সংসদ নির্বাচনে দেওয়া সেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের হলফনামায় দেখা গেছে ওই বাড়ির হোল্ডিং নম্বর-৩৬৩ নম্বর শের-এ-বাংলা রোড। একইভাবে বুধবার রাতে নগরীর দোলখোলা ইসলামপুর রোডের ইসলামপুর মসজিদের দক্ষিণ পাশের দেলোয়ার হোসেন দেলো নামের এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। সেখানেও বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দৃশ্যমান হোল্ডিং নম্বর মেলেনি। যদিও উত্তেজিত ছাত্র-জনতা বুধবার রাতে ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে নিচতলায় রক্ষিত ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-৮৮৫৭ নম্বরের একটি হেরিয়ার গাড়িসহ কয়েকটি মোটর সাইকেল ও অন্যান্য মালামাল পুড়ে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলে বাড়ির দ্বিতীয় তলার একাংশ থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।

একই রাতে নগরীর লবণচরা থানাধীন লবণচরা এলাকার তালুকদার আব্দুল খালেক সড়কের অ্যাড. আইয়ুব আলীর চার তলা বাড়ির জানালার গ্লাস ভাংচুর করে কিছু লোক। ওই বাড়িতেও বুধবার দুপুরের পর গিয়ে কোন দৃশ্যমান হোল্ডিং নম্বর পাওয়া যায়নি। বাড়িটির সামনের মোল্লাবাড়ি নামের বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর(৯০/২২) দৃশ্যমান রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এডভোকেট আইয়ুব আলী বড়মাপের কোন নেতা না থাকলেও তিনি ছিলেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পতিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের কথিত পোষ্য। যে কারণে তার বাড়ির সামনের সড়কটির নামকরণও করা হয় তালুকদার আব্দুল খালেক। এ জন্যই ওই এলাকার ছাত্র-জনতা ক্ষীপ্ত হয়ে বাড়িটি ভাংচুর করে। একইভাবে নগরীর দোলখোলা মোড়ের দেলোয়ার হোসেনও শেখবাড়ির দোসর হিসেবে পরিচিত থাকায় তার বাড়িটিও বুধবার রাতে ভাংচুর করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮ টার দিকে খুলনা জেলার দিঘলিয়ার নগরঘাট এলাকায় শেখ হাসিনার পৈত্রিক সম্পত্তিতে ভাছচুর ও লুটপাট চালিয়েছে স্থানীয়রা। এ সময় তারা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় তারা ‘আমার সোনার বাংলায় মুজিববাদের ঠাঁই নাই, জ্বালো-জ্বালো আগুন জ্বালো, আওয়ামী লীগের আস্তানা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, মুজিববাদের আস্তানা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও সহ বিভিন্ন স্লোগান দেয়। জানা যায়, পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবুর রহমান তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে খুলনার দিঘলিয়ার ভৈরব নদের পাশে নগরঘাট এলাকায় ১ একর ৪৪ শতক (৪ বিঘা) জমিতে পাট গুদাম ও এক কক্ষের ঘরসহ জমি কেনেন। ওই জমিতে নির্মাণ করা হয় পাট গোডাউন, যা বর্তমানে ‘শেখ হাসিনার গোডাউন’ নামে পরিচিত। দিঘলিয়ায় এই ৪ বিঘা জমির কথা শেখ হাসিনা নিজেও জানতেন না। ২০০৭ সালে তার ব্যক্তিগত আইনজীবীর মাধ্যমে ওই জমির কথা জানতে পারেন। শেখ মুজিব তার জীবদ্দশায় পাটের গুদাম ও এক কক্ষের আধাপাকা ঘর ছিল সেই জমিতে। এই পাট গুদাম দেখাশোনা করতেন শেখ মুজিবের ছোটভাই শেখ আবু নাসের।

এদিকে রাতের এ ঘটনার পর সকাল থেকেই নগরীর খালিশপুর, দৌলতপুর, খানজাহান আলী ও সোনাডাঙ্গা থানার বিভিন্ন এলাকায় এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে মুজিব, হাসিনার মুর্তি, নামফলক, আবাসিক হলের সাইনবোর্ড অপসারণ ও ভাংচুর করা হবে বলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্ততি গ্রহণের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এরমধ্যে বিএল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মুজিবের মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে।

নগরবাসী জানান, এটা পাওনা ছিল। এ ভবনের প্রতিটি ইট পাথরে মিশে আছে দুনীর্তিও টাকা। মিশে আছে এদেশের মানুষের রক্ত। রক্ত চোষা এ বাড়ির অস্তিত্ব না রাখাই উচিত। এসময় ছাত্র-জনতা স্লোগান দিতে থাকে ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ ‘শেখ বাড়ির আস্তানা ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’, স্বৈরাচারের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, শেখ বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের দাপটে শেখ বাড়ি থেকে খুনি হাসিনার চাচাতো ভাইয়েরা মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করেছেন। তারা জবরদখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোবাজি, জুলুম-নির্যাতন, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়, ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ বিপুল অর্থে সহায়-সম্পদ গড়েছেন। কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন। চৌদ্দ পুরুষের সারাজীবন বসে খাওয়ার মতো সম্পদ তারা গড়ে নিয়েছেন। সব অপকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শেখ বাড়ি। এই বাড়ির ওপর মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

৫ আগষ্টের পর গা ঢাকা দেওয়া অনেক আওয়ামী লীগ নেতা কিছুদিন ধরে খুলনায় পদচারণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বুধবার রাত থেকে আবার অনেকেই হারিয়ে গেছেন। শেখ বাড়ি ভাংচুরের খবর পেয়ে রাতেই অনেকেই খুলনা ত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায়। এমনকি শেখ বাড়ি বসে কয়েকজন সাবেক কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অনেকের নাম ধরে তাদের বাড়িতে হামলার কথা জানিয়েছিল ছাত্র-জনতা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সদ্য জাগ্রত হওয়া কোন কোন নেতা আবারো আত্মগোপনে চলে যান। এমনকি অনেকের বাড়ির মালামাল রাতেই সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

অপরদিকে খুলনায় শেখ বাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র জনতা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবৃতি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলা শাখা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার অফিসিয়াল পেইজ এবং যুগ্ন আহবায়ক মহরম হাসান মাহিমের ভেরিফাইড আইডিতে শেয়ার করা ৬ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) রাতে দেওয়া এই বিবৃতিতে বলা হয়, এতদ্বারা জানানো যাচ্ছে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার সহযোদ্ধা, শুভাকাঙ্ক্ষী শুভ্যানুধ্যায়ী বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে ৫ই ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির অভয় অরেণ্য খ্যাত কিবলা “খুলনার শেখবাড়ি” ছাত্র-জনতা মাটির সাথে মিশিয়ে বিলীন করে দিয়েছে।