সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘নিরাপত্তা, দুর্নীতি ও জ্বালানি’ বিষয়ক সংলাপে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, শুধু অতীতের নয় বর্তমানের দুর্নীতি থামানোর দিকেও নজর দিতে হবে। এ দেশে উন্নয়নের জন্য প্রকল্প করা হয় না, দুর্নীতির জন্য প্রকল্প করা হয়। আইন করা হয় দুর্নীতি থামানোর জন্য কিন্তু এ দেশে আইন ও নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়েছে বলে জানান তারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সিরডাপ মিলনায়তনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-এর সভাপতি জিল্লুর রহমান। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত), সেন্টার ফর গভার্ন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সাবেক কূটনৈতিক এম শফিউল্লাহ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম; খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের; বাংলাদেশের জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, গণফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ, গণঅধিকার পরিষদের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়া সম্পাদক ফজলুল করীম মারুফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির, এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার পত্রিকার সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন।
জ¦ালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আইন করা হয় দুর্নীতি থামানোর জন্য। কিন্তু এদেশে আইন ও নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়েছে। আমরা জ্বালানি খাতে দুর্নীতির কাঠামো ভেঙে দিয়েছি। ৩.২ বিলিয়ন বকেয়া ছিল জ্বালানি খাতে। অনেক বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে। আমরা প্রতিযোগিতা আবারও চালু করেছি।
তিনি বলেন, তেল নিতে হলে আগে রিফাইনারি মালিক হতে হতো। এটি আমরা বাদ দিয়েছি। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও প্রকল্প আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। রোজার সময় সাধারণত লোডশেডিং হয়। এখন কমেছে। এতে বোঝা যায় লোডশেডিং কমানো সম্ভব। আমরা চেষ্টা করছি আগামী সরকারের যেন পরিবর্তন আনতে সুবিধা হয়। এ টেমপ্লেট আমরা তৈরি করছি।
উপদেষ্টা বলেন, এখন পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগে না। আগে এ জায়গায় অনেক দুর্নীতি হতো। আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির নীতি তৈরি করেছি। দুর্নীতির বিষয়ে আমরা আমাদের কাজে সন্তুষ্ট নই। একটি বড় সমস্যা হলো, অনেকেই চান দুর্নীতি থাকুক যাতে তারা এর থেকে সুবিধা নিতে পারেন। শুধু অতীতের নয় বর্তমানের দুর্নীতি থামানোর দিকেও নজর দিতে হবে। এ দেশে উন্নয়নের জন্য প্রকল্প করা হয় না, দুর্নীতির জন্য প্রকল্প করা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সিকিউরিটির পাঁচটি তাত্ত্বিক দিক আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি ও সমাজ। সিকিউরিটি অব দ্য পিপল নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। মানুষের নিরাপত্তা না থাকলে সেই রাষ্ট্র অর্থহীন। নতুন টেকনোলজি বা সাইবার সিকিউরিটি আমাদের নিরাপত্তার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া, ফেক নিউজ, ফ্যাক্ট চেক এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ও আমাদের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবে তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও জ্বালানি আমাদের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করছে। আমাদের কনভেনশোনাল চিন্তা-ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা এখনও সব বিষয়ে ঐকমত্য হতে পারি নাই। সব বিষয়ে ঐকমত্য হলে সেখানে সন্দেহ তৈরি হয়। তাই আমদের ডাইভারসিটিকে জায়গা দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। অধৈর্য হওয়া যাবে না। আধুনিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি, আমাদের চিন্তা-ভাবনাও আধুনিক করতে হবে। ইনডেমনিটি আইন দ্বারা জ্বালানি খাতে দুর্নীতি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এলএনজি খাতে দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এর জন্য দরকার কার্যকর গণতন্ত্র। আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচন অঙ্গনকে পরিষ্কার করতে হবে। দুর্নীতির মূল চালিকা শক্তি হলো টাকা। আমাদের টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে ছিল তখন তারা সিকিউরিটির ওপর গুরুত্ব বেশি দিয়েছিল। দুর্নীতি দমনে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। আইন থাকা সত্ত্বেও গত তিনটি নির্বাচন ঠিক মতো হয় নাই। রাজনীতিকে দুর্নীতি মুক্ত না করতে পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।
মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, জুলাই বিপ্লবোত্তর অনেক কমিশন করা হলেও, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো কমিশন করা হয় নাই। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো কৌশল নেই। পানি নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরও আলোচনা করতে হবে। সীমান্তে মানুষ হত্যা নিয়ে জোরাল কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় নাই বিগত ও বর্তমান সরকারের সময়ে। আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তায় অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। বাংলাদেশে মাদক পাচার বন্ধ করতে হবে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমাদের থ্রেট অনেক বেশি। এগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িত; আলাদা নয়। আমরা ২২টা সমস্যাকে চিহ্নিত করেছি। এগুলো সমাধান করলে আমাদের উন্নতি হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার, জ্বালানি সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি রোধ করতে পারলে সামগ্রিকভাবে আমাদের উপকার হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনই এখন দুর্নীতি করে থাকে। পুলিশের মধ্যেও দুর্নীতি হচ্ছে। অনলাইন সার্ভিসের মধ্যে চলে আসলে দুর্নীতি অনেক কমে যাবে।
এম শফিউল্লাহ বলেন, স্নায়ু যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করছি। এর বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্র বারবার ক্রিটিসাইজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রটি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
ড. এম শামসুল আলম বলেন, আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গিয়েছি যে তারা জ্বালানি নিরাপত্তা তাদের ইস্তেহারে কীভাবে নিশ্চিত করবে। কিন্তু আমি কোনো উত্তর পাই নাই তাদের কাছ থেকে। আমাদের জ্বালানি সেক্টরকে আমদানিনির্ভর করার চেষ্টা করা হচ্ছে গত ১৫ বছর ধরে।
ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, বিগত সরকার জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা নিজেরাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমান সরকারকে আমরা বসিয়েছি বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন করার জন্য। আইন আরও করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। টাকার খেলা ও পেশীর খেলা বন্ধ করতে হবে। অসীম নির্বাহী ক্ষমতা বন্ধ করতে হবে।
নাজমুল হক প্রধান বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করে আসছি। ভিন্ন মতকে কেউ নিতে পারে না এখন। ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করতে হবে।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে দলগুলো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। প্রধান উপদেষ্টা চেষ্টা করেছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করার। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কেবল সরকার না, রাজনৈতিক দলগুলোকেও আলোচনা করতে হবে।
হাসনাত কাইয়ুম বলেন, রাষ্ট্র, রাজনীতিবিদ ও সমাজের মনস্তত্ত্বের দায়িত্ব দুর্নীতি দমন করা। রাষ্ট্র, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে যারা জড়িত তাদের মধ্যে দুর্নীতি বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে বা তাদের দুর্নীতির বাইরে রাখতে হবে। তাহলে সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের রাষ্ট্রের কাঠামোতে নিরাপত্তা বাড়ালে জনগণের নিরাপত্তা বাড়বে। এতে করে বাইরের কোনো শক্তি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন ১২ বার হয়েছে। নির্বাচনের মধ্যেও জনগণের কোনো আশা পূরণ হয় নাই। পুলিশ বাহিনীর ৮০ শতাংশ এখনও আওয়ামী লীগের লোক। পুরনো সেটআপ বহাল থাকলে বর্তমানে কোনো পরিবর্তন হবে না।
ফজলুল করীম মারুফ বলেন, আমাদের তথ্য অধিকার আইন সংস্কার করার জন্য সুপারিশ করা হয় কিন্তু তা হয় নাই। এটি ব্রিটিশ আমলের আইন। আমাদের সরকার পরিবর্তন কি স্নায়ু যুদ্ধের অংশ কিনা ? আওয়ামী লীগ তাই বলছে। যদিও এটি জনগণের চাহিদা থেকেই হয়েছে। কিন্তু এটি নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেশপ্রেম কম। কথায় আছে টাকা দিয়ে রাজনীতিবিদদের কেনা যায়। এটি করুণ অবস্থা আমাদের জন্য। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে নিরাপত্তার সরল রৈখিক সম্পর্ক রয়েছে। এর ওপর আরও গবেষণা দরকার। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা প্রবেশের পর আমরা রোহিঙ্গা নিয়ে বেশি আলোচনা ও গবেষণা শুরু করি। এর আগে এটি নিয়ে আলোচনা তেমন ছিল না।
সাফকাত মুনির বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নিয়ে কোনো কমিশন গঠন করা হয় নাই। আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্রাকচার তৈরি করতে হবে। আগামী নির্বাচিত সরকারের উচিত জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে টাস্ক ফোর্স তৈরি করা। সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে আমরা তেমন আলোচনা করি না। এটিকে সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তার লেন্সে দেখতে হবে। আগামী নির্বাচিত সরকারকে সাইবার সিকিউরিটির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
ইনাম আহমেদ বলেন, গত ১৬ বছরে ইচ্ছামতো টাকা লুটপাট ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। কারণ গণতন্ত্র অনুপস্থিত ছিল। পত্রিকার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। পত্রিকা যখন না লিখতে পারে তখন ওই সমাজে গণতন্ত্র আর থাকে না। এটি হয়েছে আমাদের দেশে বিগত সরকারের সময়ে।