মতানৈক্য থাকবে, তবে মতবিরোধ যেন না হয়
চূড়ান্তপ্রার্থী তালিকা সময়মতো ঘোষণা করা হবে
প্রবাসীদের ভোটার হওয়ার সময় ১৫ দিন বাড়ানো হউক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান সৌদি আরবে পবিত্র উমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। গতকাল ভোর ৫:৩০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বহু নেতাকর্মী আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। দেশের মাটিতে পা দিয়ে আমীরে জামায়াত বলেন, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সাথে দেখি। তিনি বলেন, আমরাই সবার আগে আমাদের নায়েবে আমীরের পক্ষ থেকে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে একটা সমাধানে পৌঁছি দেশ এবং জাতির স্বার্থে। আমরা আশা করি অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন ইনশাআল্লাহ।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান (সাবেক এমপি) ও মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম (সাবেক এমপি), সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ (সাবেক এমপি), মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মোঃ শাহাবুদ্দিন ও মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মোঃ সেলিম উদ্দিন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, সহকারী সেক্রেটারি কামাল হোসাইন, ড. আবদুল মান্নান, শামসুর রহমান, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী মাহফুজুর রহমান, নাজিম উদ্দিন মোল্লা, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমানসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী।
এ সময় আমীরে জামায়াত প্রেস ব্রিফিং-এ বলেন, গত মাসের ১৯ তারিখ আমি উমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে উমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সাথে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহর নিউ ইয়র্ক, বাফেলো, মিসিগান ও ওয়াসিংটন ডিসি যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী যারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, তাদের সঙ্গেও মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তাদের কথাগুলোও শোনার সুযোগ হয়েছে এবং বিভিন্ন ব্যাপারে আমরা তাদেরকে আশ্বস্ত করে এসেছি। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা মেসেজ হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের সেই অবদানের জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম এবং এ দাবি আমরা ছেড়ে দিইনি। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথম বারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে। ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। সেখানে পানির বিল কারেন্টের বিল দিল কিনা-হোল্ডিং ট্যাক্স দিল কিনা অনেকে ১০-২০ বছর যাবৎ দেশের বাইরে গেছে; তারা এগুলো ব্যবহারও করে না, বিল দেওয়ার প্রয়োজনও হয় না। এগুলো শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা এগুলোকে সহজ করার আহ্বান জানাব।
তিনি বলেন, আরেকটা মেসেজ আমরা তাদেরকে দিয়ে এসেছি। তাদের দায়িত্ব শুধু দেশকে দেওয়া নয়। দেশের দায়িত্বও তাদেরকে সম্মান দেওয়ার এবং মিলেমিশে প্রবাসে নিবাসে যারা আছেন, আমরা সবাই মিলে সবগুলো হাত একত্রিত করে, সবগুলো মেধা এক কেন্দ্রে এনে আমরা আমাদের দেশকে ইনশাআল্লাহ আগামী দিনে সামনে আগাতে চাই। এই জন্য আমরা বলেছি জাতীয় সংসদ হবে সরকার পরিচালনা এবং দেশ গঠনের সর্বক্ষেত্রে প্রোপোরশনিক হারে তারা সেখানে ইনশাআল্লাহ অংশগ্রহণ করবেন। তাদের সেই জায়গাটা নিশ্চিত করা হবে ইনশাআল্লাহ। এটা হয়ত সময় লাগবে। আজকে বললে আজকেই হবে না। কিন্তু এটি আমাদের স্বপ্ন। স্বপ্ন বুনলে আল্লাহ একদিন তা বাস্তবায়ন করবেন ইনশাআল্লাহ। আমরা সেই স্বপ্নের দিকে আগাব ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, এরপর সর্বশেষ আমি তুরস্কে এসেছিলাম। সেখানেও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সাথেও আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছি জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি এবং যেখানেই গিয়েছি একটা কথা বলার চেষ্টা করেছি যে দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং সমতার ভিত্তিতে। আল-হামদুলিল্লাহ আমরা যত জায়গায় গিয়েছি তাদের এ্যাপ্রিসিয়েশন আমরা পেয়েছি। তারাও মন খুলে আমাদের সাথে কথা বলেছেন। আমরাও মন খুলে আমাদের সবগুলো বিষয় তাদের সাথে শেয়ার করেছি। এই সফরে যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে অথবা আলাপ আলোচনা হয়েছে, সেগুলো যেন দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত হয়, কোনো ব্যক্তি নয়, গোষ্ঠী নয়, দল নয় দেশ ও জাতির যেন উপকার হয়।
তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা এত সকালে কষ্ট করে এখানে এসেছেন, আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনাদের জাতির কল্যাণে কবুল করুক, সবাইকে আরেকবার ধন্যবাদ।
প্রশ্নোত্তর : বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন আমীরে জামায়াত। এক সংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথম প্রশ্ন হল আমি ‘আমীর’ নির্বাচিত হয়েছি, না আমি ‘আমীর’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার উপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই। বিএনপি তারাও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আর প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, এটি চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে। আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা বিভিন্নভাবে আঞ্চলিকভাবে এটা আমরা জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা ইনশাআল্লাহ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরও অনেককে আমরা ধারণ করব দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি বুঝতে পেরেছি, মতানৈক্য কেন? আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সাথে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই।
সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, উনারা বেঁধে দেয় নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভিতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, সরকারের জন্য এটা ভাল এবং আমরাই সবার আগে আমাদের নায়েবে আমীরের পক্ষ থেকে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে একটা সমাধানে পৌঁছি দেশ এবং জাতির স্বার্থে। আমরা আশা করি অন্যরা আমাদের এই আহ্বানকে সাড়া দেবেন ইনশাআল্লাহ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গণভোটের ব্যাপারে তো আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি আমরা দিয়ে দিয়েছি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই, ইনশাআল্লাহ। শুধু আমরা না, সবাইকে নিয়ে।
ভোর হওয়ার আগেই প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য হাজার হাজার নেতাকর্মী বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান করছিলেন। আমীরে জামায়াত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে হুডখোলা গাড়িতে বের হন। এ সময় রাস্তার দুই পাশে অপেক্ষমান জনতা তাকে অভিবাদন জানায়। আমীরে জামায়াত হাত নেড়ে তার জবাব দেন।