বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরছেন, গত কয়েক মাস গণমাধ্যমসহ দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে এমন আলোচনা চললেও কবে তিনি ফিরবেন সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। সম্প্রতি তার নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের সরকারের উচ্চ মহলের সাথে বৈঠকের পর এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, শিগগিরই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তবে তারেক রহমান ঠিক কবে নাগাদ দেশে ফিরছেন, সে বিষয়ে ঢাকায় বিএনপির নেতারা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। তবে তারা বলছেন, তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। দীর্ঘ ২১ বছর পর নিজের মন্ত্রণালয়ে গেলেন তিনি। বৈঠকটি সম্পূর্ণ সৌজন্যমূলক বলা হলেও, বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে তার সার্বিক ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে বলে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সীমান্ত নিরাপত্তা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ দমন সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু মতবিনিময় হয় বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছাড়াও বিশেষ সহকারী খোদাবক্স চৌধুরী, সিনিয়র সচিব নাসিমূল গণি এবং পুলিশের (আইজি) বাহারুল আলম, সাবেক সিনিয়র সচিব কামরুজ্জামান এবং সাবেক এডিশনাল আইজি মাহবুবুর রহমান অংশ নিয়েছেন।

এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলে সরকার ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রদানে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। ফিরে আসার বিষয়টি (দেশে ফেরার) তারেক রহমানের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তবে যখনই প্রয়োজন হবে, তার ভ্রমণ নথি বা পাসপোর্ট সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমরা দেখব। এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা জানান, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে তারেক রহমান পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন কি না সে সম্পর্কে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। তৌহিদ বলেন, তারেক রহমানকে প্রথমে দেশে ফেরার ব্যাপারে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারেক রহমান। সে হিসেবে সেটি চলতি বছরের শেষের দিকে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে সেটিও চূড়ান্ত কিছু নয়। তার আগেও আসতে পারেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, তারেক সাহেব নিশ্চয়ই দেশে ফিরবেন, অবশ্যই দেশে ফিরবেন। কবে ফিরবেন, সে প্রশ্নের জবাবে বলেন, শিগগিরই ফিরবেন। তবে দিনক্ষণ কোনো কিছু বলেননি বিএনপির মহাসচিব।

এ বিষয়ে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তারা দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতাকে দেশের মাটিতে গণ-অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি এখনই ফিরবেন কি না, সে বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। এ ক্ষেত্রে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসহ নানা দিক বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। তাই কোন সময় দেশে ফিরলে বিএনপির রাজনৈতিক অর্জনের পাশাপাশি ব্যক্তি তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনটা উজ্জ্বল হয়, সেটি দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় বিএনপি। সেদিন বিমানবন্দরসহ রাজধানীতে বৃহত্তম জমায়েত করার পরিকল্পনা রয়েছে দলের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তারেক রহমানের দেশে ফিরলে তার নেতৃত্বে দলের পক্ষে একটি জোয়ার সৃষ্টি করে নির্বাচনে ভালো ফল আদায় করা সম্ভব হবে।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করেছিলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর পর তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, সেদিন যদি তিনি ফিরতেন, তাহলে বিমানবন্দরে লাখো মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত হতো। কিন্তু কেন সেই সময় দেশে ফিরলেন না তিনি, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। চলতি বছর ৬ মে লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে ফেরার সময়ও অনেকে আশা করেছিলেন তারেক রহমানও ফিরবেন। যদিও তার বদলে দীর্ঘ ১৭ বছর পর তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান শাশুড়ির সঙ্গে দেশে ফিরেছিলেন। সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। তিনি জানিয়েছিলেন, জুবাইদা রহমান ফিরেছেন, তারেক রহমানও ফিরবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতিকে এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ করতে তারেক রহমানের প্রয়োজন রয়েছে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের উপস্থিতি অতীব জরুরি। জাতি, রাষ্ট্র এবং জনগণের সংকটে দৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তারা বলেন, খালেদা জিয়ার যে শারীরিক অবস্থা, তাতে দল ও দেশের মানুষ চাইলেও তার পক্ষে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করা কঠিন হবে। বয়সের চেয়েও বড় সমস্যা তার শারীরিক জটিলতা। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অনেকগুলো বড় অসুখে ভুগছেন। সুতরাং আগামী জাতীয় নির্বাচন যেদিনই হোক, সেই নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের সুযোগ পেলে খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, সংসদীয় পদ্ধতিতে তুলনামূলক কম দায়িত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হওয়াটাও কঠিন হবে বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে তারেক রহমানের বিকল্প দলে কেউ নেই।

সূত্র মতে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে এতদিন আলোচনায় থাকা তিনটি প্রধান বাধা ছিল মামলায় সাজা, পাসপোর্ট জটিলতা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মামলাগুলোর রায় তার পক্ষে এসেছে। তবে পাসপোর্ট নিয়ে বিতর্ক এখনো আছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর তার পাসপোর্ট নবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এখন আর পাসপোর্ট পাওয়া তেমন কঠিন হবে না। সব মামলায় খালাস পাওয়ার পর তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে কেবল একটি বিষয়ই গুরুত্ব পাচ্ছে-নিরাপত্তা।

তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবিরও তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রসঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দেন। তিনি বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপরও কিছুটা নির্ভর করবে। নির্বাচনের একটা পরিষ্কার রোডম্যাপ দিতে হবে। উনার মতো এত বড় একজন নেতার নিরাপত্তার ব্যাপারও আছে। যখন অন্তর্বর্তী সরকার একটা স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি দিতে পারবে, উনার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারবে তখন তিনি আসবেন। তিনি আরো জানান, উনি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তা না। তবে আমি যেটা বলছি, উনার মতো একজন সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা, যাকে দেশের ভেতরে এবং বাইরে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই তার কিছু আন্তর্জাতিক সিকিউরিটির ব্যাপার-স্যাপার আছে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা রয়েছে কি না এই প্রশ্নে দলটির শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে সরাসরি কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম বলেন, তারেক রহমান ফিরবেন বা ফিরবেন না সেটা উনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারেক রহমান দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে আসার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, আমরা চাই তিনি দেশে আসুন। বেগম জিয়া দেশে নিরাপদেই আছেন, এ দেশের মানুষ তাকে বরণ করে নিয়েছে। যে দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে নিরাপত্তা দিয়েছে, তারা তারেক রহমানকেও নিরাপত্তা দিতে পারবে। দেশের মাটি-মানুষের ঘ্রাণ তারেক রহমানের দ্রুত নেওয়া দরকার। এটা দেশপ্রেমেরও বহিঃপ্রকাশ। কারণ দূর থেকে দেশের মানুষকে খুব সহজে অনুভব করা যায় না।