গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো ফের এক কাতারে এসেছে। এরই অংশ হিসাবে আজ রাজধানীর শাহবাগে সর্বদলীয় সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন। সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে গণঅধিকার পরিষদ।

অবিলম্বে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটকে নিষিদ্ধের জোর দাবি জানিয়ে নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। তাদের দোসর জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোট শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার হতে সহযোগিতা করেছে। ফ্যাসিবাদ ফেরাতে জাতীয় পার্টি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, এত অপরাধের পরেও এখন দেশকে অস্থির করতে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে আওয়ামী লীগের দোসর ও ভারতীয় এজেন্ট জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৪ দলীয় জোটকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকালে রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে তিন দাবিতে গণঅধিকার পরিষদের সংহতি সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন।

তিন দফা দাবি হলো- গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় জড়িতদের শাস্তি, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও রাজনীতি নিষিদ্ধসহ ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ।

তবে তিন দফা দাবিতে সমাবেশ হলেও বেশিরভাগ বক্তাই জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের কথা জানিয়ে বক্তব্য দেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশে সংহতি জানান। ফ্যাসিবাদ বিরোধী দলগুলোর নেতারা একই মঞ্চে পাশাপাশি বসে এদিন নিজেদের মধ্যে ঐক্য মজবুত করার আহ্বান জানান।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল বলেন, গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। এখন তো স্বৈরাচার নাই। তাহলে আজ নূরকে রক্তাক্ত করছে কারা? আমরা বারবার ড. ইউনূসকে বলেছি, অন্তর্বর্তীর্কালীন সরকারের বিভিন্ন স্তরে স্তরে হাসিনার আন্ডাবাচ্চারা রয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। ব্যবস্থা কিছু কিছু হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় নাই। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হয়েছে, এলোপ্যাথি চিকিৎসা হয় নাই। হাসিনার সেই আন্ডা বাচ্চাদের বিরুদ্ধে শুধু এলোপ্যাথি নয়, অস্ত্রপাচার করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে নানা গুজব এবং প্রোপাগান্ডার কথা তুলে ধরে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখছে। অনেকেই ভাবছেন জাপা (জাতীয় পার্টি) দিয়ে আবার আপা (শেখ হাসিনা) আইসা ( এসে ) পড়বে। অনেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন, স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখতে কিন্তু বাধা নেই, স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে চ্যাপ্টার ক্লোজড। এই চ্যাপ্টার আর খোলার সুযোগ নাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা একটি মৃত মানুষ।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমরা খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এই (নুরের) হামলা কোন একটি দলের ওপরে ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের ওপরে হামলা, এই হামলা দেশের গণতন্ত্রের ওপর হামলা, এই হামলা জুলাইয়ের রক্তের বিরুদ্ধে হামলা। আমরা যে ৫ই আগস্ট দেশ থেকে ফ্যাসিবাদকে বিদায় করেছিলাম, সেই ফ্যাসিবাদ ও তার দোসরদের ফিরে আসার আরেক অপচেষ্টা এই হামলা।

তিনি বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে, কিন্তু এই ফ্যাসিবাদকে যারা তৈরি করেছিল, সেই জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল এখনো আছে। তাদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার আর কোন সুযোগ নেই। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দল মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চায়।

সভাপতির বক্তব্যে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, নুরের ওপর হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের যেসকল সদস্যরা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নুর এখনো পর্যন্ত হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। অবিলম্বে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় সচিবালয় ঘেরাও করা হবে। আর আমরা বাংলাদেশে জাতীয় পার্টিকে রাজনীতি করতে দেব না। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির উপর ভর করে ফিরে আসতে চাচ্ছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মোহাম্মদ আতাউল্লাহ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা সফল হয়েছি, কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। একসঙ্গে হামলা ও মামলার শিকার হওয়ায় আমরা শেখ হাসিনাকে হটাতে পেরেছি। কিন্তু আজকে আমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকার কারণে নুরুল হক নুরকে মার খেতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করার পাঁয়তারা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশ আর কোনো যেনতেন নির্বাচন করতে দেব না। তবে আমরা নির্বাচনের পক্ষে। সংস্কার করে যদি নির্বাচন নভেম্বরে দেয়া হয় তাহলেও আমরা অংশগ্রহণ করবো।

ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, নুরুল হক নুরের মতো একজন বিপ্লবী নেতার ওপর হামলার নিন্দা জানাই। হাসিনার দোসররা পুলিশ, সেনাবাহিনীতে রয়েছে। আমরা জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ চাই। আর কোন ফ্যাসিস্ট যেন বাংলাদেশে জন্ম না নেয়, সেজন্য আমরা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবো।

হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, নুরকে আঘাত করা হয়নি। যারা ১৬ বছর আন্দোলন করেছে, তাদেরকে আঘাত করা হয়েছে। আমরা সবাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে। জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলসহ আওয়ামী লীগের সকল সহযোগি দলকে নিষিদ্ধ করে আগামী নির্বাচন করতে হবে।

লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমরা সংস্কার, বিচার এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনও চাই। এক বছরের অন্তর্বতী সরকার কতটা সংস্কার করেছেন, সেটা জনতা জানতে চায়। সুশীলের নামে আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তি টিভিতে গিয়ে বক্তব্য দেয়। আমরা জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ চাই।

এসময় আরও বক্তব্য দেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির শিকদার হারুন মাহমুদ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইযহার, গণসংহতি আন্দোলনের বাচ্চু ভূঁইয়া, এবি পার্টির আনোয়ার সাদাত টুটুল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দলের (পিএনপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ মোহাম্মদ লিটন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) রাশেদ প্রধান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মোমিনুল আমিন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) একাংশের ক্বারী আবু তাহের, খেলাফত মজলিসের মুহাম্মদ মুনতাসির আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. আবু মূসা মোহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টির আবুল কাশেম মজুমদার, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মো. শামসুদ্দিন পারভেজ, ডেমোক্রেটিক লীগের খোকন চন্দ্র দাস, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) অপর অংশের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ-আল-হারুন, জনতার অধিকার পার্টির (পিআরপি) তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এসময় গণধিকার পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।