নাম উল্লেখ না করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সাবেক সচিব ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এটা আবদুস সাত্তারের নিজস্ব বক্তব্য। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সততার ওপর পূর্ণআস্থা রয়েছে তার দলের। অন্যদিকে উপদেষ্টাদের দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ আছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আবদুস সাত্তার। তিনি সময়মত তা জমা দিবেন বলেও জানান।
আবদুস সাত্তারের বক্তব্যের বিষয়টি উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমি বলতে চাই, হুইচ ইজ নট আওয়ার্স। এটার সঙ্গে আমাদের (বিএনপি) কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা প্রধান উপদেষ্টাসহ এই অন্তর্বর্তী সরকারের সব উপদেষ্টাকে অত্যন্ত সম্মান করি এবং তাদের ওপর আস্থা, তাদের ইনটিগ্রিটির (সততা) ওপর আমরা আস্থা রাখি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ওই বক্তব্যের দায় সম্পূর্ণভাবে ওনার (আবদুস সাত্তার) নিজের। দলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
আবদুস সাত্তার বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন । তিনি আওয়ামী লীগের আমলে যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসরে যান। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা হয়। আওয়ামী লীগের পতনের পর আবদুস সাত্তার অফিসার্স ক্লাবের (সরকারি কর্মকর্তাদের ক্লাব) সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি পদেও রয়েছেন। মূলত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
কয়েকজন উপদেষ্টার দুর্নীতি নিয়ে আবদুস সাত্তার বক্তব্য দেন গত শুক্রবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমানসহ বেশ কয়েকজন আমলা সেখানে বক্তব্য দেন। দর্শক সারিতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের বহু কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে নাম উল্লেখ না করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র অভিযোগ করেন আবদুস সাত্তার। অবশ্য তার বিরুদ্ধেই সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ থাকা অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে সরকারের নানা পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া হয়।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে পরেরদিন শনিবার একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের নজরে এসেছে; যেখানে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এ বি এম আবদুস সাত্তার নাম উল্লেখ না করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। আমরা এই অভিযোগগুলো দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। প্রমাণ উপস্থাপন বা ব্যক্তিদের শনাক্ত না করে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং জন আস্থার জন্য ক্ষতিকর।
শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিবৃতিতে বলা হয়, যতক্ষণ না এমন প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমরা সকল অংশীজনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে জনপরিসরের আলোচনা অনুমান নয়, বরং তথ্যের ভিত্তিতে হওয়া সমীচীন। বিবৃতিতে আবদুস সাত্তারের কাছে সব প্রমাণ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের প্রশাসন স্বচ্ছতা, সততা এবং জবাবদিহির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদি আবদুস সাত্তারের কাছে কোনো অসদাচরণের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকে, আমরা তাঁকে যথাযথ আইনগত ও তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তা দ্রুত জমা দেওয়ার আহ্বান জানাই।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আবদুস সাত্তার গত রোববার পর্যন্ত কোনো প্রমাণ জমা দেননি। পাশাপাশি এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়াও জানাননি। বিষয়টি নিয়ে জানতে আবদুস সাত্তারকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়, ফোন করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে রাজধানীর বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে পাওয়া যায় তাকে। জানতে চাইলে তিনি গণমাধমে বলেন, তার কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। তিনি তা জমা দেবেন। প্রমাণ কবে জমা দেবেন, কী প্রমাণ আছে, তা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিবৃতিতে বলা হয়, যতক্ষণ না এমন প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমরা সকল অংশীজনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে জনপরিসরের আলোচনা অনুমান নয়, বরং তথ্যের ভিত্তিতে হওয়া সমীচীন। শনিবার বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসোসিয়েশনও একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, শুক্রবার অনুষ্ঠিত সেমিনারের মূল প্রবন্ধ ও বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে দু-একটি গণমাধ্যম উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য নয়। বিষয়টি নিয়ে শনিবার রাতে অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি তখন গণমাধ্যমে বলেন, আবদুস সাত্তার যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি একান্তই তার নিজের বক্তব্য।
অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসোসিয়েশন শনিবার আরেকটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়, আবদুস সাত্তার উপদেষ্টাদের নিয়ে যে মতামত দিয়েছেন, তা একান্তই তার নিজস্ব বক্তব্য। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এ বক্তব্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা পূর্ণ আস্থার সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব কার্যক্রম বাস্তবায়নে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।