জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে। নতুন প্রস্তাবিত কমিটির কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) এর পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কমিটি শুধু সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও তিন বাহিনীর প্রধানের নিয়োগ এ কমিটির অন্তর্ভুক্ত হবে না।
গতকাল বুধবার ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার ষষ্ঠ দিন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
এ সময় কমিশনের সহ-সভাপতি জানান, আলোচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিদ্যমান মূলনীতি অটুট রাখার বিষয়ে কয়েকটি দল মত দিয়েছে, আবার কিছু দল ভিন্নমতও পোষণ করেছে। তাই এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। তবে, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি এবং পক্ষপাতিত্বহীনতা - এ পাঁচ বিষয়ে অধিকাংশ দলের সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, যেহেতু সংবিধান এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে চুড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে এখনো উপনীত হওয়া যায়নি, তাই প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
আলোচনার শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি এবং আপনাদের সাথেও আলোচনা করছি। এ অব্যাহত আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন-সংযোজনের মধ্য দিয়ে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে অর্থাৎ একটি জাতীয় সনদে পৌঁছাতে পারব। রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আলোচনায় ক্ষেত্রবিশেষে মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ কমিশনের বৈঠক ছাড়াও আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে পরষ্পরের মধ্যে মতবিনিময় করছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি-সহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। আগামী রবিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন হতে গতকাল প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরের মেয়াদ নিয়ে বিএনপির শর্ত: জীবদ্দশায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরের ক্ষেত্রে বিএনপি একমত হলেও এখানে কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেছেন, এনসিসির মতো আর কোনো বডি নির্বাহী ক্ষমতার কর্মকা-ে বাধাগ্রস্ত করে বা ইন্টার ফেয়ার করে কিংবা ওই ব্যবস্থা থাকলে আমরা সে প্রস্তাব গ্রহণ করবো না। তিনি বলেন, এনসিসির মতো ব্যবস্থা থাকলে আমরা আগের অবস্থায় থাকবো (প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর মানবো না)। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এখনো আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি, ব্যাপারটি পেন্ডিং রয়ে গেল।
গতকাল বুধবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের একথা জানান সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, আলোচনার প্রথম বিষয়- সংবিধানের মূলনীতি, দ্বিতীয় বিষয়- সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি (আগে যেটা এনসিসি ছিলো) এবং তৃতীয় বিষয়- হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ সংক্রান্ত।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সংশোধিত প্রস্তাব হলো- সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি উল্লেখিত হবে। এটি তারা করবে যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে। আমরা বলেছি, রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সাথে পঞ্চম সংশোধনীতে যে আর্টিকেলগুলো ছিল সেগুলো সংযোজন করব। এবং সমস্যার কমিশনের উপরোক্ত বাক্যগুলো আমরা সংযোজন করব। তবে এটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটা পেন্ডিং রয়ে গেল।
তিনি বলেন, এনসিসির পরিবর্তে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি প্রস্তাব করেছে ঐকমত্য কমিশন। সেটি হলো- সদস্যবৃন্দ (প্রস্তাবিত) প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার (নিম্নরুক্ষ), স্পিকার (উচ্চকক্ষ), বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর একজন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি (আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন), প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল একজন বিচারপতি। এতে ৭ জন দাঁড়ায়। আগের দুইটি বিষয়ে বাদ দিয়েছে, সেটি হলো- তিন বাহিনীর প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ- এ কমিটির আওতাভুক্ত থাকবে না।
দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, সংবিধানের নতুন একটা বডি চাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে সকল সাংবিধানিক পুরুষের জন্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন রয়েছে, তার মধ্যে সংস্কার করা হোক এবং ওইখানে সার্চ কমিটি গঠন করে দেয়া হোক। নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে সেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আইনে নিয়োগের ব্যবস্থা থাকবে। সে সকল প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্য আইন থাকবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সে বিধানগুলো এখানে সংযুক্ত করতে হবে। সেই আইনগুলো আমরা যদি মানসম্মত করি, সার্চ কমিটিকে যদি সেভাবে নির্ধারণ করি, আইনগুলো সেভাবে প্রণয়ন করতে পারি। এভাবেই রাষ্ট্রের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হবে।
বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, মুক্ত গণমাধ্যম যদি নিশ্চিত করতে পারি, দুদকসহ অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলো যদি আমরা স্বচ্ছ করতে পারি। এগুলোই গণতন্ত্র রক্ষার কবচ হিসেবে কাজ করবে। এগুলো না করে শুধুমাত্র নির্বাহী বিভাগকে ক্ষমতা কমিয়ে, সব জায়গায় কাটিল করে একটা সুষ্ঠু রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হয় না।
জীবদ্দশায় প্রধানমন্ত্রীর পদে সময়ের ১০ বছরের ক্ষেত্রে বিএনপি একমত তবে শর্ত দিয়ে তিনি বলেন, এনসিসির মতো আর কোনো বডি নির্বাহী ক্ষমতার কর্মকা-ে বাধাগ্রস্ত করে বা ইন্টার ফেয়ার করে কিংবা ব্যবস্থা থাকলে আমরা সে প্রস্তাবটা গ্রহণ করবো না। এনসিসির মতো ব্যবস্থা থাকলে আমরা আগের অবস্থায় থাকবো। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এখনো আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি, ব্যাপারটি পেন্ডিং রয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে জামায়াতের অভিমত: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, বিএনপি বাদে অধিকাংশ দল যেহেতু এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন এখন বাস্তবায়নের দায়িত্ব হলো ঐকমত্য কমিশনের। আমরা দেখি উনারা কী করেন।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপের ষষ্ঠ দিনের দ্বিতীয় পর্ব শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এ ব্যাপারে আমরা সবাই ঐক্যমত পোষণ করেছি। এই আলোচনাটা আজকেও উঠেছিল, কিন্তু বিএনপি আজকেও এই পয়েন্টে একমত হয়নি। এই হলো আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
তিনি আরো বলেন, আমরাও সরি নাই এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সরে নাই। এই পয়েন্টে সবাই এখন পর্যন্ত ঐকমত্যই আছে যে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। অধিকাংশ দল যেহেতু এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন এখন বাস্তবায়নের দায়িত্ব হলো ঐকমত্য কমিশনের। আমরা দেখি উনারা কী করেন। আমরা বিশ্বাস করি, উনারা এ ব্যাপারে শক্ত থাকবেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' যুক্তকরণে ঐকমত্য হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাবনা এসেছে। যেখানে 'সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি' উল্লেখিত হবে। এই কথার সাথে পঞ্চম সংশোধনীর 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' যুক্ত করার ব্যাপারে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছে। তবে, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছে।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির নাম বাদ দিয়ে নতুন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সাথে এনসিসির নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন প্রস্তাবিত কমিটিতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, নিম্নকক্ষ স্পিকার, উচ্চকক্ষ স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত অন্যান্য বিরোধী দলের দলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে একজন, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত একজন এবং প্রধান বিচারপতি কর্তৃক আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। এই প্রস্তাবনাতেও বিএনপি সহ কয়েকটি দল বাদে অধিকাংশ দলই ঐকমত্য পোষণ করেছে।
এ বিষয়ে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, এই কমিটির প্রস্তাবনা এসেছে যাতে করে রাষ্ট্রের কোনো একক ব্যক্তির স্বৈরাচার হতে না পারে। ফ্যাসিবাদী শাসন যাতে প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। এর থেকে দেশ, জাতি, রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্যই কিন্তু এই প্রস্তাবনার সাথে আমরা একমত হয়েছি।
বৈঠকে রাষ্ট্রের মূলনীতি, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি), জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন কাঠামো, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও নারী প্রতিনিধিত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে।