মাহমুদ শরীফ, কুমারখালী (কুষ্টিয়া) সংবাদদাতা : দেশের কৃষি ও বস্ত্রশিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসন জামায়াত-বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক নির্যাতন-নিপীড়ন ও দুঃশাসনে ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল এই জনপদ। দেড় দশক ভোটাধিকার বঞ্চিত ছিল দুই উপজেলাবাসী। জুলাই বিপ্লবের পর ভোট প্রদানের সেই সুযোগ এসেছে। সবাই স্বপ্ন দেখছে উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার। বইছে বেশ জোরেশোরেই ভোটের হাওয়া। শহরসহ পাড়া মহল্লায় ভোট উৎসবের ইমেজ দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা পলাতক থাকায় কর্মীরা টু শব্দ করছে না। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বিভিন্ন স্পটে ব্যানার ফেস্টুন গেট-তোরণ স্থাপন করে ভোটারদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছেন। এলাকায় ভোটারদের আকাক্সক্ষা পূরণে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী আফজাল হোসাইন, বিএনপির চার জন, ইসলামী আন্দোলনের একজন ও গণঅধিকার পরিষদের একজনসহ আরো কয়েকজন নেতা।
এই আসনে ভোটের মাঠে সব দলের নেতারা নিজ নিজ আঙ্গিকে তৎপর থাকলেও তাদের কাজের ধরন ভিন্ন। বিএনপি নেতারা তাদের বিভিন্ন কর্মসুচী আলাদা ভাবে পালন করেন। স্থানীয় নেতাদের গ্রুপ বদল করতেও দেখা যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী বাদে বিএনপির সবাই নানারকম সংকট ও চ্যালেঞ্জের মধ্েয আছেন। নেতাদের অতীত ও বর্তমান কর্মকান্ডের ওপর নির্ভর করছে তাদের নির্বাচনি ফলাফল আর মনোনয়ন। কুমারখালী খোকসার বিএনপির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে এই গ্রুপিং আর অন্তকোন্দল।
ত্রয়োদশ নির্বাচনের আমেজ তৈরি হওয়ায় ধীরে ধীরে আরো প্রকট হচ্ছে তাদের কোন্দল আর সংকট। উপজেলা বিএনপির নেতারা এক কার্যালয়ে বসেন না। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একাধিক কার্যালয় নিয়ে দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন। প্রকাশ্যে অন্য নেতার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতেও দেখা যাচ্ছে অনেককে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা বিএনপির দলীয় নেতা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় গ্রুপিং আর কোন্দল জোরালো হয়েছে। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন যিনিই পান না কেন, কোন্দল থেকে বের হওয়া কঠিন হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। দলটির কিছু নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে ধানের শীষকে ক্রমেই কঠিন পরীক্ষায় ফেলছে বলে মনে করেন মাঠ পর্যায়ের প্রাজ্ঞ কর্মীরা।
অপরদিকে বৃহত্তম ইসলামি দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কোন্দলের এমন ঝামেলার উর্ধ্বে উঠে ইতোমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন জামায়াত প্রার্থী। জয় করার চেষ্টা করছেন ভোটারদের হৃদয়। সামাজিক কর্মকান্ডে জামায়াত প্রার্থীর সরব উপস্থিতি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। অন্য দলগুলোর নেতাকর্মীরাও মোটামুটি সরব আছেন।
দুই উপজেলায় ভোটার সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। এর মধ্যে কুমারখালীতে ভোটার আছেন দুই লাখ ছিয়াশি হাজার আট শত তেইশ জন। কুমারখালীর ভোটের উপরই নির্ভর করে চুড়ান্ত ফলাফল। ইসলামী কুমারখালীতে শক্ত অবস্থানে আছে তার প্রমাণ বিগত দিনে তিনটি ইউপি চেয়ারম্যান ও দুটি উপজেলা তিনটি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়া।
জাতীয় সংসদের এই আসনে বিএনপির দুই প্রবীণ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী এবং জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কুমারখালী পৌরসভার চারবারের সাবেক মেয়র নুরুল ইসলাম আনছার প্রামাণিকের মধ্েয রাজনৈতিক দ্বন্দ দীর্ঘদিনের। ভোটের সময়ও তাদের তেমন এক হতে দেখা যায়না। জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বিএনপির হাইকমান্ডের কাছের লোক পরিচয় দেওয়া স্থপতি শেখ সাদী এই আসনে মনোনয়ন পেতে নতুন আরো একটি গ্রুপ তৈরী করায় বিএনপি এখন তিন ধারায় বিভক্ত। শেখ সাদীকেও বেশ গনসংযোগে তৎপর হতে দেখা যাচ্ছে। তবে আনছার প্রামানিককে এবার মনোনয়ন দিলে মূল্যায়ন হবে ও শেখ সাদীকে আরো জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির প্রয়োজন বলে অনেকেই মতামত দিচ্ছেন।
অন্যদিকে সৈয়দ মেহেদী রুমীকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নিয়ে মূল্যায়িত করা উচিৎ বলেও তৃণমূলের ভোটারদের অনেকেই জানান। এছাড়াও আরেকজন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হাফেজ মঈনউদ্দিনের গনসংযোগও দেখা যাচ্ছে মাঝে মধ্যে, তিনি নিজেকে জোরোশোরেই প্রচার করার চেষ্টা করছেন। নিজ বাড়ী সদকী ইউপির মহিষখোলা থেকে কয়েক হাজার কর্মীর মটর সাইকেল বহর নিয়ে বৃহৎ শোডাউন দিয়েছেন তিনি। হাটবাজারে ঘুরে এই তরুণ কৃষক নেতা ৩১ দফা তুলে ধরছেন। দিনদিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে ।
মনোনয়ন প্রত্যাশী সবাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতকে শক্তিশালী করতে নির্বাচন করতে চান ও মনোনয়ন পাচ্ছেন বা পেয়ে গেছেন বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে আওয়ামীলীগ বার বার প্রার্থী পরিবর্তন করলেও বিএনপির প্রার্থীর কোন পরিবর্তন না থাকায় এক ঘেয়েমীতা পরিলক্ষিত হয়। দলীয় মনোনয়নের জন্য মুলত সবাই তাকিয়ে আছেন বিএনপির কেন্দ্রের দিকে।
এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী কুমারখালী উপজেলা শাখার নায়েবে আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আফজাল হোসাইন দুই উপজেলায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে প্রচারণায় এগিয়ে আছেন। আফজাল হোসেনের অনেকটা গণজোয়ার দেখা যাচ্ছে। গ্রুপিং ও কোন্দলের কারনে বিএনপি এক না হলে জামায়াত বিজয়ী হবে সহজেই এমনটি শোনা যাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের আলোচনায়।
এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ফজলে নূর ডিকো, ক্লিন ইমেজের প্রার্থী খ্যাত গনঅধিকার পরিষদের শাকিল আহমেদ তিয়াস, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আনোয়ার খানও গনসংযোগ করছেন নিয়মিত। তবে জামায়াত প্রার্থীর সাথে বিএনপির ভোটের লড়াই জমবে এটা নিশ্চিৎ বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ভোটারদের অনেকেই ।