সততা ও দক্ষতায় প্রজন্ম গড়ার প্রতিজ্ঞায় “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
সোমবার (৩০ জুন) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বিপ্লবীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় রচিত হয়েছিল বিজয়ের ঐতিহাসিক এক উপাখ্যান। জুলাই ছিল ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, জুলুম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের এক বিস্ময়কর জাগরণ। আমরা শুরুতেই স্মরণ করছি শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, শান্ত ও আলী রায়হানসহ জুলাইয়ের সকল শহীদ, আহত, পঙ্গুত্ববরণকারী এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জুলাই যোদ্ধাদের, যাদের অসীম সাহস ও সীমাহীন আত্মত্যাগে রচিত হয়েছে মুক্তির নব ইতিহাস। দেশ হয়েছে স্বৈরাচার মুক্ত, জনগণ ফিরে পেয়েছে মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ। আমরা শহীদদের শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা কামনা করছি, আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের আশু সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি।
সাংবাদিক সম্মেলনে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ছাড়াও সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, অফিস সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম, প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক মু. মু’তাসিম বিল্লাহ শাহেদী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাইদুল ইসলাম, ছাত্র অধিকার সম্পাদক আমিরুল ইসলামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগরীর নেতৃবৃন্দ এতে উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, শহীদদের নিয়ে যখন বিভিন্ন মহল দলীয়করণ ও ক্রেডিটের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে, ঠিক তখন জুলাই স্পিরিট ধরে রাখতে ছাত্রশিবির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তীসময় থেকে আজ অবধি ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নানাবিধ অর্থবহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। গায়েবানা জানাজা, কবর জিয়ারত, শহীদ পরিবারের খোঁজখবর, সহযোগিতা, ঈদ ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শহীদ পরিবারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, ‘ফ্রেমবন্দি ৩৬ জুলাই’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, গণহত্যার বিচারের দাবিতে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন, জুলাই স্মৃতিলিখন প্রতিযোগিতাসহ ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এরই অংশ হিসেবে জুলাইয়ের স্মৃতি ধারণ, গণহত্যার বিচার নিশ্চিতকরণ, জাতীয় ঐক্য সুসংহত করতে সততা ও দক্ষতায় প্রজন্ম গড়ার প্রতিজ্ঞায় ‘জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করছি। তিনি আরও বলেন, আন্দোলন প্রশমিত করতে তৎকালীন হাসিনা সরকার বেছে নিয়েছিল পেশিশক্তির মাধ্যমে দমনপীড়নের পথ। দলীয় ক্যাডার ও রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে হাজার হাজার তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করে। বাসার ছাদে খেলায় মগ্ন শিশুদেরও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশের রাজপথ, জনপদ এবং ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয় ছাত্র-জনতার রক্তে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট অনুসারে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২-১৩% ছিল শিশু ।
তিনি বলেন, সারা দেশে দুই সহস্রাধিক লাশ ও হাজারো মানুষের রক্তের পরও ফ্যাসিস্ট সরকার ভেবে ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করে স্বৈরাচারের বশ্যতা মেনে নিয়ে সবাই ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা প্রমাণ করেছে গুলি করে, হত্যা করে বিপ্লবীদের দমন করা যায় না। জুলাই আন্দোলন কোনো একক দলের বা গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি জনপদের প্রত্যেক মানুষ এক কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিল “দফা এক, দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ!
শিবিরের ঘোষিত কর্মসূচি হলো:
১. সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, রিসার্চ কনফারেন্স, আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন
২. শহীদদের কবর জিয়ারত, শহীদ পরিবার ও আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়
৩. শাখাভিত্তিক জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে ‘জুলাই দ্রোহ’ শিরোনামে বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন
৪. সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক প্লেসে ‘জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ’ শীর্ষক আলোকচিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী এবং কালচারাল ফেস্ট আয়োজন
৫. জুলাই গ্রাফিতি অঙ্কন
৬. জুলাইয়ের গল্প ও স্মৃতি বলা, স্মৃতিলিখন, বক্তব্য, রচনা, বিতর্ক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রভৃতি আয়োজন
৭. শহীদদের নামে লাইব্রেরি/পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
৮. শহীদ পরিবার, আহত ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী গাজীদের নিয়ে ‘ত্যাগীদের চোখে আগামীর বাংলাদেশ’ শীর্ষক সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও পডকাস্টের আয়োজন
৯. জুলাইয়ের ওপর সাহিত্য সাময়িকী ও বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ।
১০. জুলাই স্মৃতি লিখন প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান ও জুলাই প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন ও প্রদর্শনী। এবং
১১. ‘ঞযরহশ ইধপশ ঃড় ৩৬ ঔঁষু’ শিরোনামে ৩৬ দিনব্যাপী অনলাইন ক্যাম্পেইন।
কর্মসূচিগুলো শিবিরের কেন্দ্র থেকে শুরুর করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ৩৬ দিনব্যাপী পালন করা হবে।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনের স্পিরিট ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে গণহত্যাকারীদের বিচার, শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন, গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবর্তন, ক্যাম্পাসসমূহে ছাত্র সংসদ-ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার ও বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গঠন। যেখানে নিশ্চিত হবে নাগরিকের ন্যায্য অধিকার, নির্মূল হবে জুলুমতন্ত্র আর প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করছি যে, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে কিছু ব্যক্তি ও দল জুলাইয়ের স্পিরিটকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। যেখানে ছোটখাটো বিভেদকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্য অটুট রাখাই হচ্ছে প্রধান দায়িত্ব, সেখানে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অপপ্রচার, দায় চাপানো, অহেতুক ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্যের মাধ্যমে বিভাজন তৈরি করছে। তারা আরও বলেন, জুলাইসহ বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী সন্ত্রাসের শিকার শহীদ পরিবার, আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের বিষয়ে আশানুরূপ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বিগত আওয়ামী রেজিমের সময় ছাত্রশিবিরের গুম হওয়া ৭ জন ভাইকে ফিরে পেতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
ছাত্রশিবিরের নেতারা বলেন, জুলাইয়ের ১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে, অথচ জুলাই সনদ ঘোষণা করতে পারেনি সরকার। আমরা মনে করি, সকল অপতৎপরতার ঊর্ধ্বে জুলাই অভ্যুত্থানকে বিজয় ও বিপ্লবে রূপান্তর করতে প্রয়োজন জুলাই ঘোষণাপত্র। যেখানে জুলাই আন্দোলনে শহীদ, আহত-পঙ্গুত্ববরণকারী ও অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত পল্টন ট্র্যাজেডি, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, গুম, অবৈধ নির্বাচনসহ সকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে হবে। দেশের সঠিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে।
তারা বলেন, ১৯৯০ সালের পর সর্বশেষ ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমের দুরভিসন্ধি। স্বৈরাচার পতনের পর একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে আগ্রহ দেখালেও একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে বানচাল করতে নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ককটেল বিস্ফোরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও অদৃশ্য ইশারায় নির্বাচন দিতে গড়িমসি করছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা ফ্যাসিবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ, যা দেশপ্রেমিক সচেতন ছাত্রসমাজ কখনোই মেনে নেবে না। আমরা অতিদ্রুতই সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা ও তার আলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।