“বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো মানুষ তৈরির পাশাপাশি ভিন্ন কিছু তৈরি করছে” -এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের একটি সনদনির্ভর ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। এই ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করলেও দিন শেষে তিনি মানুষ হচ্ছেন কিনা, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব নেই, নেই সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো হিসাবও।”
গতকাল রোববার সকাল ৯টায় নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন কিং অব চিটাগং কনভেনশন সেন্টারে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর আয়োজিত এসএসসি/দাখিল ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, “বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ছিলেন আগ্রাসনবাদী আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি তাঁর সহপাঠীদের নামাজের দিকে আহ্বান করতেন, প্রতিবাদ করতেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সে কারণেই তাঁর সহপাঠীরাই তাঁকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করেছে। যারা তাঁকে হত্যা করেছে, তারাও নিশ্চয়ই সমান মেধাবী ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি জিনিসের অভাব ছিল — তা হলো মানবতা। তাই আমাদের আগে মানুষ হতে হবে।”
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি সেক্টরে স্থান খুবই সীমিত। তাই কতটুকু পরিশ্রম ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তোমরা তোমাদের স্থান দখল করবে, সেই সিদ্ধান্ত আজই নিতে হবে — উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে তোমাদের কেউ কেউ শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, পুলিশ, ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিবিদ হবে। তাই আহ্বান করবো, তোমরা যে–যে সেক্টরেই যাও না কেন, মানবিক গুণাবলি ধরে রেখো।”
“ডাক্তার হও, তবে এমন ডাক্তার হইয়ো না, যে চেয়ে চেয়ে দেখবে রোগী মারা যাচ্ছে — কিন্তু পেমেন্ট না দেওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করবে না। প্রকৌশলী হইয়ো, তবে এমন প্রকৌশলী হইয়ো না, যে নিজের জ্ঞান দিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করে নিজের পকেট ভারী করে। এমন ব্যবসায়ী হইয়ো না, যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকিং সেক্টরে অবস্থানধারী বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংককে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। ব্যবসায়ী হইয়ো এমন, যে পুরো সমাজকে আলোকিত করতে ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।”
সর্বোপরি, জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মানবিক শিক্ষক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, “পরিমলের মতো শিক্ষক হইয়ো না, যে নিজের ছাত্রীর সম্ভ্রমহানি করে। অনুসরণ করো মাইলস্টোন কলেজের সেই সম্মানিত শিক্ষিকা মেহরিন ম্যাডামকে — যিনি নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচাতে।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েলের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনোনীত চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ডা. আবু নাসের, চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ডা. একে এম ফজলুল হক, চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. তানভীর মো. হায়দার আরিফ, ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা কার্যক্রম সম্পাদক আলাউদ্দীন আবির, ইউরোপিয়ান কমিশনের এশিয়া সেন্ট্রালাইজড সাপোর্ট ফর ইরাজমাস ন্যাশনাল ফোকাল পয়েন্টের রিজিওনাল ম্যানেজার ড. মোহাম্মদ আশিকুর রহমান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর ভারপ্রাপ্ত আমীর পরিবেশবিদ মো. নজরুল ইসলাম।
সভাপতির বক্তব্যে তানজীর হোসেন জুয়েল বলেন, “স্মরণ করছি জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও গাজী ভাইদের — যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৩ সালের এমন একটি সময়েও আমরা এ ধরনের একটি প্রোগ্রামের আয়োজন করেছিলাম, যেটিকে ‘দেশদ্রোহী নাশকতার প্রোগ্রাম’ বলে উল্লেখ করে আমাদের ছাত্রছাত্রী ভাইদের গ্রেপ্তার করা হয়, অতিথিদের গ্রেপ্তার করা হয়। আমাদের বারবার ভয় দেখানো হয়। তবে মামলা, হামলা ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে তারা আমাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারেনি, পারেনি আমাদের দমিয়ে রাখতে।”
ডা. আবু নাসের শহীদ আব্দুল মালেকের আত্মত্যাগের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার একজন পথপ্রদর্শক, যার গৌরবময় ইতিহাস আমাদের কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান, তোমরা ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার রক্ষার্থে শহীদ আব্দুল মালেকের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করো।”
ডা. একে এম ফজলুল হক অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালে রসদ জোগান কেন্দ্র করে স্কুল ও কলেজ জীবনে ছাত্রলীগ ও যুদ্ধ-পরবর্তী শেখ মুজিবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিই। তবে মেডিকেলে এসে কিছু ভাইয়ের আদর্শিক কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রশিবিরে যোগদান করি। আলহামদুলিল্লাহ, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আল–কোরআনের বাণী প্রচারে কাজ করার চেষ্টা করছি।”
ড. তানভীর মো. হায়দার আরীফ বলেন, “বাংলাদেশ সৎ মানুষের দেশ। তাই তোমরা নিজেদের সৎ ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলো, যাতে তোমাদের কাঁধে ভর করেই এই দেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।”
অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী বলেন, “আগামীর ইনসাফভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে মেধাবীদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থী বান্ধব বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।”
মোহাম্মদ আলাউদ্দীন আবির বলেন, “মানুষের মধ্যে দাসত্ব, পশুত্ব ও মানবত্ব -এই তিনটি সত্তা বিদ্যমান। তাই দাসত্ব ও পশুত্বের শৃঙ্খল ভেঙে আমাদের আগে আদর্শ মানুষ হতে হবে।”
ড. আশিকুর রহমান বলেন, “শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর যেসব গুণাবলি অর্জন করা প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম হলো মনোভাব ও আত্মবিশ্বাস। কারণ এই গুণাবলি গুলো একটি সমাজ এবং পরবর্তীতে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে।”
এসময় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকগণ তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। সবশেষে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতি শিক্ষার্থীদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেওয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।