ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এর আগে সিলেট বিভাগের নেতাদের সাথে বৈঠক করেছে দলটি। এসব বৈঠকে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই বৈঠককে ঘিরে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে বিভিন্ন সংসদীয় আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পক্ষে নেতাকর্মীরা গুলশান কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, আগামী মাসের শুরুতে বিএনপি যে দুই শতাধিক প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, সেটি সামাল দেয়া দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হতে পারে। যদিও বিভিন্ন আসনের নেতাকর্মীরা এরই মধ্যে বলছেন, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ছাড়া বিকল্প প্রার্থী করা হলে তারা সেটি মানবেন না। তবে বিএনপির হাইকমান্ড বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র মতে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এখন বহুমুখী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কূটনৈতিক যোগাযোগ সংগঠন আর প্রচারণা-পরিকল্পনা মিলিয়ে দলটি কৌশলগতভাবে এগোচ্ছে। কিন্তু প্রার্থী বাছাই, দলীয় শৃঙ্খলা ও সংসদীয় ভাবমূর্তি রক্ষা-এসবই এখন দলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে হাইকমান্ড মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে তিনটি স্পষ্ট নির্দেশনা জারি করেছে- নিজ ঐক্য দৃঢ় রাখা, বিশৃঙ্খলা থেকে বিরত থাকা এবং যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষে একজোট হয়ে কাজ করা। নির্দেশনা অমান্য করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা আরও কড়া হবে বলে জানানো হয়েছে। হাইকমান্ডের তরফ থেকে বিভিন্ন জেলার নেতাদের মাধ্যমে ঐক্য রক্ষা ও দ্বন্দ্ব মেটানোর বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। গুলশানে চেয়ারপার্সনের অফিসে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডেকে আলাপ-পরামর্শ করার চিত্র বাড়ছে তবে এ প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতদোষের অভিযোগও উঠেছে। কিছু এলাকায় স্থানীয় সংগঠক বা শীর্ষ নেতার পছন্দের না হলে প্রার্থীকে ডাকা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিএনপির শীর্ষ পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এলাকাভিত্তিক নানা জরিপ ও মূল্যায়ন করে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নেতাকেই প্রার্থী করা হবে। এক্ষত্রে যারা দলকে সিদ্ধান্ত অমাণ্য করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি কার্যকর করা হবে। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বার্তা হচ্ছে, প্রার্থী ঘোষণা করলে সকলেই মনোমালিন্য ভুলে প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করবে-এটাই প্রধান নির্দেশনা।

তবে দলের একাধিক নেতা জানান, আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিরসন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। দেশের অধিকাংশ জেলায় স্থানীয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডার, দুর্নীতি, প্রতিপক্ষের সাথে সংঘাতে জড়ানো, দলের অধীন বিভেদ সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ কেন্দ্রীয় অফিসে নিয়মিত জমা পড়ছে। যদিও বিভিন্ন জেলা থেকে এমন অভিযোগ আসার পর সংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর সেই শাস্তি তুলে নেয়ার ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, নানা অভিযোগের কারণেই ইতোমধ্যে সাত হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কার, শোকজ, পদোন্নতি বাতিল সহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছে যদিও সবাইকে একসঙ্গে রাখারই চেষ্টা, তবু যারা দলের রীতি-নীতি ভাঙবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারে তৃণমূলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এতে ভোটের মাঠে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে বলে তারা মনে করছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে দলেরই কেউ যদি অন্যায় করে, তাকে ছাড় দেয়া হয়নি এবং ভবিষ্যতেও দেয়া হবে না। দলের নাম ভাঙিয়ে অনাচার করলে তার দায় দল নেবে না। যাদের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা-সৃষ্টির অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে ইসি। আর এর মধ্যে দিয়ে কার্যত নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দলের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। যারা নিজের প্রার্থিতা নিশ্চিত করে ফেলেছেন তারা কালক্ষেপণ না করে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন। বাকিরা প্রার্থিতা নিশ্চিতের গ্রিন সিগন্যাল পেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবার যেহেতু স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে সব পক্ষ আশাবাদী, ফলে স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভোটারদের কদর হবে সবচেয়ে বেশি। প্রার্থীদেরও জনগণের কাছে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। তরুণ ভোটারদের অনেকে এই প্রথমবার ভোট দিতে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে যেভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন, সংসদ নির্বাচনেও শিক্ষিত, সৎ ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী বিবেচনায় নিতে ভুল করবে না। সবকিছু মিলিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রার্থীদের জন্য নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের সঠিক প্রার্থী বাছাই ভোটের মাঠে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থীদের গণমানুষ ও তারুণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। এছাড়া রাজনৈতিক দলকে প্রার্থী নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার ডেডিকেশন, সততা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেখতে হবে গত ১৫ বছরের লড়াইয়ে সে ছিল কিনা। এখন মানুষ দেখতে চায় যারা প্রার্থী হবেন তাদের নেতৃত্ব, যোগ্যতা, ভিশন এবং দক্ষতা। বিশ্লেষকরা আরও বলেন, গত এক বছরে রাজনৈতিক মাঠ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এই উন্মুক্ত মাঠে খেলার ধরন কি হবে, খেলাটা কার পক্ষে যাবে তা অত সহজে আগে প্রাক্কলন করা কঠিন। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ভুল করে ফেলতে পারে। এ কারণে নির্বাচনে দলের ব্যাপক গ্রহযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রার্থীর অগ্রহণযোগ্যতার কারণে ফলাফল সেভাবে পক্ষে নাও আসতে পারে। এবার যারা ভালো ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দিতে পারবে, তারাই জয়ের পথে এগিয়ে যাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, গতানুগতিক ধারায় যে নির্বাচনী প্রচার চলে আসছিল, সেটা এবার পরিবর্তিত হয়ে যাবে। স্যোশাল মিডিয়া পুরো নির্বাচনজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। পেশিশক্তি এবং আর্থিক কারণে আগে যেমনভাবে প্রার্থী হতো, এবার তা নাও হতে পারে। এবার প্রার্থী মনোনয়নে যেসব বিষয় প্রাধান্য পাবে-সেগুলো হলো গণমানুষ ও তারুণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং রাজপথের আন্দোলনের ভূমিকা।

সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা বিএনপির বহু নেতাকর্মী যথাযথ মূল্যায়িত হচ্ছে না। কিছু ‘হাইব্রিড’ নেতা যারা পূর্বে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে তারা বর্তমানে বিএনপির ভেতরে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কোথাও এমন নেতারা পদ-পদবি দখলে নিচ্ছেন এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এ বাস্তবতায় ভুল সিদ্ধান্ত নিলে দলে ভাঙন ও অনৈক্য সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা বিএনপির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কিছু আসনে বাদ পড়া প্রার্থীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে পারেন, এতে দলের ভেতরে টানাপোড়েনও সৃষ্টি হতে পারে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিশ্বাস, চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণা হলে সব প্রার্থীই নির্বাচিত প্রার্থীর পক্ষে একজোট হবেন এবং বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে। গত ১৬-১৭ বছরে অনেক নেতা আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, রাজপথে থেকেছেন। একই আসনে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতে পারে। তবে যে প্রার্থী ভোটার টানতে পারবে, মানুষের কাছে যার গ্রহণযোগ্যতা বেশি, কর্মী-সমর্থক বেশি এবং যোগ্য তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বড় দলে প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। অতীতেও প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। যাচাই-বাছাই করে তাদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তখন সবাই মিলে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন, কাজ করেছেন। এবারও তাই হবে। প্রার্থী বাছাই তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে না।