বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ঘোষিত কিংবা সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক সক্রিয় দেখা গেলেও দলটির সামনে কার্যত তিনটি বিষয় এখন বিশেষ চ্যালেঞ্জ বা সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দলের সব স্তরেই।
তারেক রহমানের দেশে ফেরার তারিখ এখনো ঠিক না হওয়া
লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন কিংবা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় পনের মাস পরেও তার ফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছে কেন- তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে দলের ভেতরেই।
অক্টোবরেই বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো যে নভেম্বরেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই মাসেই বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান নিজেও দ্রুত ফেরার আশা প্রকাশ করেছিলেন।
তখন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকেও বলেছিলেন যে, নভেম্বরের মধ্যেই মি. রহমানের দেশে ফেরার আশা করছেন তারা।
তবে বাস্তবতা হলো নভেম্বর শেষ হতে আর চার দিন বাকী থাকলেও দলটি এখনো তারেক রহমানের দেশে ফেরার তারিখ ঘোষণা করতে পারেনি। অথচ শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে পনের মাস আগে।
তারপরেও এই দীর্ঘ সময়ে তারেক রহমান ফিরলেন না কেন সেই প্রশ্নের জবাব কারও জানা নেই। যদিও তারেকের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
এর মধ্যে ঢাকায় তার জন্য বাড়ি প্রস্তুত করা ও বুলেট প্রুফ গাড়ি কেনার তৎপরতা নিয়ে একাধিক খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যেই দুটি বুলেট প্রুফ গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপির দিক থেকে জানা গেছে।
কিন্তু তারপরেও তিনি আসছেন না কেন কিংবা তার আসার বিলম্বের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে কি-না নাকি দলীয় কোনো কৌশলের অংশ হিসেবেই তিনি আসতে বিলম্ব করছেন- এসব নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে দলের ভেতরে বাইরে।
দলের একাধিক নেতা অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। যদিও তফসিলের আগে কেন আসবেন না- সেই প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, তফসিল ঘোষণার পরেও যদি তারেক রহমানের আসতে বিলম্ব হয় তা হলে 'অনেকের মধ্যে যে সন্দেহ' তা আরও ডালপালা মেলবে এবং বিএনপির জন্যও সেটি সংকট তৈরি করবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, তারা আশা করছেন তারেক রহমান আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং শিগগিরই দেশে ফিরবেন। তবে এখনো কেনো তার আসা বিলম্বিত হচ্ছে তা নিয়ে কোনো মন্তব্য মোশাররফ হোসেন করেননি।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা
উদ্বেগ দেখা দিয়েছে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেও। দলের পক্ষ থেকে 'উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু হয়নি' বলা হলেও তা দেশজুড়ে দলটির নেতাকর্মীদের কতটা আশ্বস্ত করতে পেরেছে তা নিয়ে সংশয় আছে।
ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির দিক থেকে যে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নাম তিনটি আসনের বিপরীতে প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে।
গত ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭ আসনের প্রার্থীদের (পরে একটি আসনে প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়) নাম ঘোষণা করেছিলো। সেখানে খালেদা জিয়াকে তিন আসনে প্রার্থী করার বিষয়টি অনেককেই বিস্মিত করলেও বিএনপির অভ্যন্তরে এটি কর্মী সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করেছিলো বলে মনে করা হয়।
যদিও দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসাধীন থাকায় এবারের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন না বলেই অনেকে আগে ধারণা করেছিলেন। আবার যখন নাম ঘোষণা হলো, তখন দলের ভেতরে এমন আলোচনাই জোর পাচ্ছিলো যে খালেদা জিয়াকে সামনে রেখেই নির্বাচনটি করতে চাইছে বিএনপি।
কিন্তু হুট করে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং সে কারণে গত রোববার তাকে আবার হাসপাতালে ভর্তির পর দলের ভেতরে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
চিকিৎসকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি নতুন করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তার হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
তার চিকিৎসকদের দলের একজন সদস্য মঙ্গলবার জানিয়েছেন, তাকে খুবই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সেখানে সার্বক্ষণিক মনিটর, ডাক্তার ও নার্স রাখা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ড প্রতিটি মুহূর্ত সক্রিয় আছে।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, তারাও আশা করছেন যে খালেদা জিয়া দ্রুতই চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরবেন এবং সামনে থেকেই দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাবেন।
কিন্তু তারপরেও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে এবং দলের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের কাছেও দোয়া চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় দোয়া-মিলাদের আয়োজন করছে দলের বিভিন্ন ইউনিট।
মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, খালেদা জিয়া বিএনপিকে দীর্ঘকাল ধরে সংকটকালে ঐক্যবদ্ধ রেখে দলটির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন এবং সে কারণেই তাকে নিয়ে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ থাকাই স্বাভাবিক।
‘তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দিতে না পারলেও তাকে সামনে রেখেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। কারণ তিনিই দলটির ঐক্যের প্রতীক। অসুস্থ থাকলেও তিনি আছেন এবং এটিই দলটির জন্য বড় শক্তি। খালেদা জিয়া না থাকলে পরিস্থিতি কি হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না’ – বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
দলীয় মনোনয়নকে ঘিরে বিরোধ- কোন্দল বেড়ে যাওয়া
ওদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা কিংবা তারেক রহমানের ফেরা নিয়ে এখনো থাকা ‘অনিশ্চয়তা’ ছাড়াও বিএনপিকে এখন যে সংকট গভীর চিন্তায় ফেলেছে, তা হলো দলের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা।
একদিকে দলটি যেসব আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৫০টির মতো আসনে ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন বা বক্তব্য দিচ্ছেন সেসব এলাকার বিএনপির অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
কোনো কোনো জায়গায় সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালিত হয়েছে এবং প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে ক্রমশ এ ধরনের প্রতিক্রিয়া বাড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, যা অনেক জায়গায় দলটিকে অস্বস্তিতেই ফেলেছে।
এছাড়া সমমনা দলের নেতাদের জন্য যেসব আসন বিএনপি শূন্য রেখেছে এখনো সেগুলোকে ঘিরেও নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের বেশ কিছু আসন বিএনপি স্থানীয় নেতৃত্ব অন্যদের ছেড়ে দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে যেসব আসনের প্রার্থীর বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য অভিযোগ আছে কিংবা যেখানে যোগ্য আরও 'ত্যাগী' নেতা আছেন সেসব এলাকায় প্রার্থিতা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে।
সোমবার তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সভাতেই এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মনোনয়ন নিয়ে দলের মধ্যে কাজ এখনো চলছে এবং তার আশা শিগগিরই এ নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যা কেটে যাবে।
তার ভাষ্য, এটাকে সংকট বলা যাবে না। বিএনপির মতো বড় দলে এটা স্বাভাবিক। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। এগুলো থাকবে না এবং আমাদের নেতাকর্মীরা সারাদেশেই সবাই মিলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবে।