এভাবে চলতে থাকলে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হবে--------- নাহিদ ইসলাম

প্রধান উপদেষ্টাকে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করে দলটির ৪ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হয়। বিস্তারিত কথা বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।

প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা ছিলেন, জামায়াত ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। এদিন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রবেশ করে প্রতিনিধিদলটি।

সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জুলাই সনদ প্রসঙ্গে আমরা দুটি স্পষ্ট কথা বলেছি, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বহু লোকের পরিশ্রমে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আমরা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছি, তার মধ্যে মৌলিক কয়েকটি পয়েন্ট আছে। এখন প্রয়োজন এটাকে আইনি ভিত্তি দেওয়া, এটাকে বাস্তবায়ন করা এবং এই সনদের মধ্যে যেগুলো আগামী নির্বাচন সম্পৃক্ত-সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকে আগেই পাস করিয়ে তার ভিত্তিতে নির্বাচন দেওয়া। এটা হলো গুরুত্বপূর্ণ। আমাদেরকে বলা হয়েছে, যেসব পয়েন্টে আপনারা একমত হয়েছেন সেগুলো নিয়েই (জুলাই) সনদ, এটা স্বাক্ষর করুন। বাস্তবায়নের ব্যাপারে আমরা আপনাদের সঙ্গে একমত হয়েই সেগুলো আমরা করব। আমরা আজ এটা বাস্তবায়নের জন্য উনার (প্রধান উপদেষ্টা) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন, এটা বাস্তবায়ন যদি না হয়, তাহলে এই পরিশ্রম প-শ্রম ছাড়া কিছু নয়। সেকারণে তিনি বলেছেন, আমি যতটুকু উদ্যোগ নেবো, আমরা সে ব্যাপারে বলেছি, একটি আদেশের মাধ্যমে এটাকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে হবে। ড.ইউনূস এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। একটা আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।

নির্বাচনের দিন গণভোট হলে আইনগত জটিলতা তৈরি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট না হলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশের কল্যাণের জন্য কিছু টাকা অতিরিক্ত খরচ হলেও গণভোট আগে করা ছাড়া উপায় নেই।

জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘গণভোটের ব্যাপারে বিএনপি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিল না, তবে শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হয়েছে। এরপরেই তারা একটি জটিলতা তৈরির চেষ্টা করছে, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একদিনে হতে হবে। দুটি একেবারেই আলাদা জিনিস। নির্বাচন হচ্ছে কারা সরকার ক্ষমতায় আসবে তা নির্ধারণ করতে আর গণভোট হলো আমাদের কতগুলো সংস্কার যে কীভাবে সরকার পরিচালিত হবে, কীভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ কী হবে, এসব মৌলিক বিষয়। দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা বলেছি, গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার কমিটি এটা আলাদাভাবে পাস করতে হবে। জনগণ যদি হ্যাঁ বলে পাস হয়ে যাবে। জনগণ যদি না বলে পাস হবে না। জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক। জনগণ যদি হ্যাঁ বলে তাহলে সেটার (জুলাই সনদ) ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। সেটাতে একটি বিষয় আছে, উচ্চকক্ষ। তাহলে নির্বাচন ও গণভোট যদি একসঙ্গে হয়, তাহলে উচ্চ কক্ষ ইলেকশন কখন হবে? আমরা বলেছি, কোনো জটিলতা চাই না। গণভোট আগে হতে হবে। আমরা বলেছি, নভেম্বরের শেষে গণভোট করেন। এখনও এক মাসের বেশি সময় আছে। তারপরেও আরও আড়াই মাস থাকবে জাতীয় নির্বাচনের। এখানে সময়ের কোনো সমস্যা নেই।

নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির জন্য প্রশাসনে প্রয়োজনী রদবদলের আহ্বান জানালে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান জামায়াতের নায়েবে আমীর। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন, পুলিশের মধ্যে ৭০ শতাংশ লোক একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধিত্ব করে। এদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছি। সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে সরকারের নির্বাহী আদেশের ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাহের বলেন, ‘এ নিয়ে কোনো আলোচনা না হলেও জামায়াত মনে করে এই সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করতে পারে।

ডা. তাহের আরও বলেন, ‘দেশে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন আমাদের জন্য জরুরি দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য। কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি না করে আমরা আমরা সবাই মিলে যেন ফেব্রুয়ারিতে একটি আনন্দমুখর নির্বাচনে যেতে পারি, সেভাবে আচরনের জন্য আমি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাই।

জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, ‘এটা সংবিধান নয়, এটা এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট, যাতে কোনো সরকার এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে, দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন। তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন, একটি আদেশের মাধ্যমে এটি হবে। কেউ বলেছেন এটার নিয়ে অধ্যাদেশ দেওয়ার জন্য, কিন্তু অধ্যাদেশ দুর্বল। অধ্যাদেশে এগুলোতে সাংবিধানিক মর্যাদায় যাওয়ার স্ট্র্যাংথ অধ্যাদেশের নেই। কিন্তু আদেশ সাংবিধানিক পরিবর্তনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে ইকুইভ্যালেন্ট (সমকক্ষ)। সব বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, একটি আদেশের মাধ্যমেই (জুলাই সনদ) এটাকে বৈধতা দিয়ে হবে আর সেই আদেশের ওপরেই গণভোট হবে।

জামায়াত নেতা ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আপনারা জানেন নির্বাচন কমিশনে, সচিবালয়ে, পুলিশ প্রশাসনে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ কর্মকর্তাই একটি দলের আনুগত্য করছে। তারা বলছে, একটি দল থেকে প্রচ- চাপ আসছে। আমরা বলেছি, আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো আছেন। আপনি এটাকে লেভেল প্লেয়িং ফইল্ড তৈরি করেন। সবার জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরি করেন। নির্বাচনের আগে যেখানে যেখানে প্রয়োজন রদবদল করেন। উনি বলেছেন, এটি নিজে তত্ত্বাবধান করবেন এবং লটারি পদ্ধতিতে পোস্টিং দেবেন।

এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির নেতারা। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ। মিটিং শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন নাহিদ। তিনি বলেন, গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হলে পরবর্তী সংসদের একটি গাঠনিক কাঠামো থাকবে। সেই কাঠামোয় একটি সংবিধান তৈরি করবে। এই পুরা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দেবেÑতা সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটার ওপর নির্ভর করে আমরা জুলাই সদনে সই করার বিষয়টি বিবেচনা করবো। এটা সরকারের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি এবং এই দাবিগুলো যেন বিবেচনা করা হয়। আর সরকার যেন সেই পথে যৌক্তিকভাবে এই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আগায়, এ বিষয়ে জোর দাবি জানিয়েছি।

নাহিদ ইসলাম বলেন, দ্বিতীয়ত আমরা নির্বাচন কমিশনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া, কমিশনের বর্তমান আচরণ আমাদের কাছে নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে না। এটা স্বচ্ছ হচ্ছে না এবং নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেভাবে কার্যক্রম করার কথা ছিল, সেটা করছে না। কিছু কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে এবং কোনও দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা বলেছিÑবিগত সময়গুলোতে নির্বাচন কমিশন যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে কীভাবে নির্বাচন হয়েছে, সেভাবে হলে দায় সরকারের ওপর আসবে। আমরা সরকারকে সেই বিষয়টি অবগত করেছি। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। উপদেষ্টা পরিষদের বিষয়েও বক্তব্য দিয়ে এসেছি। সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন দেওয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে হচ্ছে কিনাÑবিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে এসপি, ডিসির জন্য তালিকা করে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সেই দলগুলোকে সহায়তা করছে। ফলে এভাবে চললে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলীয় পক্ষপাতের বিষয়টি যেন প্রধান উপদেষ্টা দেখেন, সে বিষয়টিও আমরা জানিয়েছি।

নাহিদ বলেন, নির্বাচন কমিশন বিষয়ে আমরা আমাদের বিষয়টা জানিয়েছি। সরকার বলেছে, এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয়, সে দায় সরকারের ওপরে আসবে। ফলে এই বিষয়টা তারা গুরুত্বসহকারে দেখবেন। সুষ্ঠু ও নিরপক্ষ নির্বাচনের জন্য যা করণীয়, তা সরকারের পক্ষ থেকে করবে। জুলাই সনদের বিষয়ে তারা আমাদের সই করার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, আমাদের বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপির এই নেতা বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আইন উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো আচরণ করলে নির্বাচন নিরপক্ষ হবে। সে বিষয়ে সরকাররে তরফে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে গঠিত হবে এবং কোনও প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে, সেখানে নোট অব ডিসেন্টে কী আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুলাই সনদে আসলে সেটা চূড়ান্ত হওয়া সম্ভব। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ফলে এই কথা যদি বলে থাকে, তাহলে তাদের কোনও ধরনের সন্দেহ রয়েছে। আমরা মনে করি, এই উপদেষ্টা পরিষদ সংস্কার ও বিচারের মাধ্যমে নির্বাচন করাটা তাদের দায়িত্বশীল আচরণ নিয়ে, কমিটমেন্ট দিয়ে, তারা সরকার গঠন করেছে।

বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক আদেশ জারি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কথা শুনেছেন এবং বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন।’ বড় রাজনৈতিক দলগুলো জেলা প্রশাসক-পুলিশ সুপারের মতো পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে বলে দাবি করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

নাহিদ বলেন, আমরা জেনেছি বিভিন্ন দল প্রশাসনে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে। বড় দলগুলো এসপি-ডিসি পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হবে। সরকার যাতে নিরপেক্ষভাবে চলে এবং উপদেষ্টা পরিষদের যাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ কমিশনের দরকার উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম সরকারের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, জনপ্রশাসনের যে পদায়ন হচ্ছে, তা কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে? নিরপেক্ষতা নাকি ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হচ্ছে।