বিএনপি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, হেফাজতসহ অন্যান্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব দল ও সংগঠন আমাদের ভাই। আমাদের সবার উচিত জুলাই আকাক্সক্ষা লালন করা। জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবিত পিআর নির্বাচন জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে সক্ষম বলেও মন্তব্য করেছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল। সাত দফা দাবিতে অনুষ্ঠিত হল জামায়াতের জাতীয় সমাবেশ। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সব গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও এক কোটির বেশি প্রবাসী ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো এককভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ করল দলটি।

গতকাল শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এ কথা বলেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাশেমী, খেলাফত মজলিসের (একাংশ) মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব এডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন এজহার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম আনোয়ারুল ইসলাম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক,

খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাশেমী বলেন, আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আল্লাহ উত্তম সাহায্যকারী, না হলে আমাদের একার কিছু করার নেই। ইসলামী হুকুমত কায়েমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাশেমী। তিনি বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণমানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করার প্রচেষ্টা করতে হবে।

আবু জাফর কাশেমী বলেন, আমরা বাংলাদেশে অনেকের শাসন দেখেছি, শোষণ দেখেছি, সোনার বাংলার শাসন দেখেছি, সবুজ বাংলার শাসন দেখেছি, জয় বাংলার শাসন দেখেছি। কিন্তু কোনো শাসন এ দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, আমি আজ সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাব, আমরা পেছনের সব মতভেদ ভুলে এ দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য মদিনা সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চেয়েছেন খেলাফত মজলিসের (একাংশ) মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের। আব্দুল কাদের বলেন, আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ব্যবস্থা করা হবে। জোর করে বা জবরদস্তি করে কেউ যেন নির্বাচন বানচাল না করতে পারে, যেনতেনভাবে নির্বাচন না করতে পারে। এটা না হলে এই জাতির মুক্তি আসবে না। প্রধান উপদেষ্টা কথা দিয়েছেন তিনি সেরা নির্বাচন উপহার দেবেন, সেটা যেন হয়।

ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের বিচার দৃশ্যমান দেখতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, আজকের সমাবেশ প্রমাণ করেছে, এ দেশে ইসলামপন্থিরা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে চায়। ২৪-এর পর যে আশা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তার বাস্তবায়ন চায়। আমরা চাই, এ দেশ নতুন করে বাঁচুক, শান্তিতে ও ইনসাফ সহকারে বাঁচুক-এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই, এ দেশে ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের বিচার দৃশ্যমান হোক, বলেন আব্দুল কাদের।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত না হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের দিকে না এগোনোর কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া আপনারা নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না। নির্বাচন তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন সব রাজনৈতিক দল নির্বিঘেœ প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে। নুরুল হক নুর বলেন, নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। সব দল যেন নির্বিঘেœ সভা-সমাবেশ ও প্রচারণা চালাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আজকের সমাবেশের এটিই একটি বড় দাবি। মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত না করে আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না। তা হলে সেটা আরেকটি প্রতারণামূলক নির্বাচনই হবে।

তিনি বলেন, যারা ইসলামী আন্দোলন করেন, তারা জানেন আল্লাহ ধন-সম্পদ, ক্ষমতা দিয়ে আবার নিয়েও পরীক্ষা করেন। গত ১৬ বছর আল্লাহ আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি বলেই তিনি আমাদের ‘রহমতের জুলাই’ উপহার দিয়েছেন। সেই জুলাইয়ে বাংলাদেশের জনগণ দৈত্য-দানবের মতো চেপে বসা ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় নতুন একটি সংকটের ইঙ্গিত দিয়ে নুর বলেন, আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি একসময়ের মজলুম শক্তি, যারা অভ্যুত্থানের অংশ ছিল, তারা আজ অহংকারে ভর করে জালিমে পরিণত হচ্ছে। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যদি আমরা সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে যাই, তাহলে শেখ হাসিনার মতো আমাদেরকেও আল্লাহ পাক ছাড় দেবেন না। তিনি সমাবেশে উপস্থিত জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ছাত্রজনতার সংগ্রাম এবং রক্তের বিনিময়ে আমরা যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন পেয়েছি, সেটিকে টেকসই করতে হলে দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে মৌলিক সংস্কার আনতেই হবে। তা না হলে এই পরিবর্তনের অর্থহীনতা প্রমাণিত হবে।

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেছেন, বাংলার মাটিতে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন মেনে নেওয়া হবে না। রাশেদ প্রধান বলেন, গত বছর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা একটা সুর তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন রাজাকার। সেই এক আন্দোলনে দিল্লীর তিলক মালি মুখ্যমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বাংলা ছেড়ে দিল্লী পালিয়ে যেতে হয়েছিল। নতুন করে আবার রাজাকার শব্দটা উত্থাপন করা হচ্ছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন। ভুল করবেন না। তিনি আরও বলেন, নতুন করে আওয়ামী লীগের স্লোগান তুলে ধরবেন না। আপনাদেরও জনতা বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেবে। আগামীর বাংলাদেশে আমরা বৈষম্য দেখতে চাই না। বাংলাদেশে আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদ দেখতে চাই না। আগামীর বাংলাদেশে আমরা চাঁদাবাজি ও পাথর দিয়ে হত্যা দেখতে চাই না।

রাশেদ প্রধান আরও বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে পদ্ধতিতে ভোট ও প্রবাসীদের ভোটাধিকার আদায়ের কথা বলছে, সেই দাবির সাথে আমার দল একমত। একইসাথে আমরা দুটি দাবি উত্থাপন করছি বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলবে না। চলতে দেওয়া হবে না। তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত ভারত থেকে পুশ ইন হচ্ছে। সীমান্তে হত্যা হচ্ছে। অতীতে আমার দেশের ফলাফল ওদিক থেকে নির্ধারণ হয়েছে। সুতরাং সকল মজলুমকে একত্রিত হতে হবে। বাংলার মাটিতে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন মেনে নেওয়া হবে না। আগামীর বাংলাদেশ হবে ইসলাম ও কুরআনের বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বঞ্চনা ও প্রতারণার অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব এডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। এসময় তিনি জামায়াতে ইসলামীকে একটি আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উল্লেখ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানান। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, যেমন চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব। জামায়াতে ইসলামীকে শুধু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, বরং একটি ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটি হিসেবে উল্লেখ করে এডভোকেট গোবিন্দ বলেন, আপনারা এখানে আসেন, শিক্ষা লাভ করেন। নীতিশিক্ষা নেন, আদর্শ শিক্ষা নেন এবং কীভাবে ধর্ম অনুযায়ী দেশ ও নিজের জীবন পরিচালনা করা যায় আপনারা সেই শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সমাবেশে উপস্থিত জনতাকে আশ্বস্ত করেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অংশগ্রহণের কারণে তাদের জীবন ধন্য হবে, এমনকি যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা নাও থাকে। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য এক দফা পৃথক নির্বাচন এবং পিআর পদ্ধতি ছাড়া কোনো নির্বাচন না করার দাবি জানান।

দেশে ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন এজহার। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ, মুজিববাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থান বাংলাদেশে হবে না। আমাদের পরিচয় আমরা মুসলমান ও বাঙালি। তার দাবি, আজকে গোপালগঞ্জে আবারও ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সমস্ত জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত কবর রচনা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আমরা আরেকটি আগস্ট ঘটাবো। যারা এ দেশে ভারতের স্লোগান আমদানি করতে চান, তাদের বলতে চাই এখনো জুলাই যোদ্ধারা জীবিত আছেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আজকের এই সাত দফা কেবল একটি রাজনৈতিক দল কিংবা আন্দোলনের ইশতেহার নয়, এটি এই জাতির টিকে থাকার শপথ। এই সাত দফা জনগণের দফা, সার্বভৌমত্বের দফা, আত্মনিয়ন্ত্রণের দফা। এই দফা বাস্তবায়ন মানে ইতিহাসের ভারসাম্য পুনর্গঠন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম আনোয়ারুল ইসলাম চান। বিডিপি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছি না। আমরা চাই, জনগণ ক্ষমতাবান হোক। আমরা চাই, সিদ্ধান্ত আসুক মানুষের হাত থেকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের নয়।

আগামীর বাংলাদেশ কালেমার বাংলাদেশ, আগামীর বাংলাদেশ ইসলামের বাংলাদেশ বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক। তিনি বলেছেন, আলেম-ওলামাদের মধ্যে বৈষম্য দেখতে চাই না। সমগ্র বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে হবে।

ফয়জুল হক বলেন, আগামীর বাংলাদেশে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, পাথর দিয়ে মানুষ হত্যা মেনে নেওয়া হবে না। আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ২০১৩ সালে নিজামি, সাঈদী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লাসহ যাদের হত্যা করা হয়েছে, সেই রক্তের জবাব দিতে হবে। তিনি বলেন, অনেকেই নতুন করে নাটক শুরু করেছে। রাজাকার ট্যাগ লাগানোর দিন শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এখন থেকে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে যারা এ রাজাকার শব্দ উচ্চারণ করে ইসলামের ঐতিহ্যকে ধ্বংসের দিকে নেবে, তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। এর জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।