জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো সুপারিশমালার কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। আজ রোববার কমিশনের কাছে দলের বক্তব্য ও সুপারিশমালা জমা দেবেন তারা। গতকাল শনিবার সকালে গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে দলের মতামত তুলে ধরে একথা জানান। এদিকে সবগুলো মামলা প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে কবে দেশে ফিরছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, উপযুক্ত সময় যখন হবে তখনই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।

সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও বেগম সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের স্প্রেড শীটের অবস্থা ও কমিশনের সদস্যদের বিভ্ন্নি সময়ের বক্তব্য ও বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে মিল পাওয়া যায়। যাতে জনমনে প্রশ্নের জন্ম হতে পারে যে, সকল বিষয়গুলো যেন একটি পূর্ব পরিকল্পনার অংশ। যা গণতন্ত্রের স্বার্থের পক্ষে কিনা বলা মুশকিল। সুপারিশমালা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, এতে ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে যা অনভিপ্রেত। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, জনগণের মালিকানার প্রতিফলন হয় নির্বাচিত সংসদ এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কিন্তু সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনীতিবিদরা অপাংতেয় এবং অনির্বাচিত লোকদেরই দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করাই শ্রেয়।

বিএনপি কমিশনকে পুরোপুরি সহযোগিতা করছে উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, আমরা প্রেরিত স্প্রেড শীটের প্রত্যেকটাতে রেন্সপন্ড করছি। যেটাতে হ্যাঁ দেয়া দরকার সেটা হ্যাঁ দিচ্ছি। যেটাতে আলাদা বক্তব্য দেয়া দরকার সেটাতে বক্তব্য দিচ্ছি। আমরা টোটালি কোআপরেট করছি।

কি কি বিষয়ে প্রশ্ন এবং কোন কোন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য-বিবৃতির সাথে মিল পাচ্ছেন তা জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা আপনারা সাংবাদিক হিসেবে অনেকগুলো জিনিস বুঝতে পারছেন। তাদের প্রস্তাবগুলো যেটা কমিশনের তার অনেকগুলো মিডিয়াতে চলেই এসেছে। সেখানে দেখবেন যে, ওই রাজনৈতিক দলগুলোর বা ব্যক্তির প্রস্তাব অনেকটাই একই রকম আসছে। স্পেসিফিক এখন আমি বলতে চাচ্ছি না। সোমবার আমাদের যে টিম যাবে সেই টিম গিয়ে তারা কথাবার্তা বলার পরে সে বিষয়ে আপনাদের সাথে তারা কথা বলবেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক ঐহিত্য, কৃষ্টি, এবং সংস্কৃতি ও ধর্মবোধ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েই বিভিন্ন সংস্কার ও সাংবিধানিক সংশোধনী প্রণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যকে সমুন্নত রেখে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বৃহত্তর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সকল সংস্কার প্রচেষ্টা পরিচালিত হবে-এটাই জাতির প্রত্যাশা।

মির্জা ফখরুল বলেন, সুপারিশমালায় সাংবিধানিক কমিশনসহ (এনসিসি) নতুন নতুন বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সমস্ত কমিশনের এখতিয়ার, কর্মকান্ডের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে যতটা সম্ভব আন্ডারমাইনিং করা এবং ক্ষমতাহীন করাই উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে একটি দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যে সমস্ত কমিশন প্রস্তাব করা হয়েছে এবং ন্যাশনাল কন্সটিটিউশনাল কাউন্সিল-এনসিসি নামে একটা ফ্রেমের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটার গঠন প্রক্রিয়া ও কায্র্ পরিধি বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে সমস্ত স্তরে স্তরে দেখা যায় অনির্বাচিত বিভিন্ন ব্যক্তিরা এই সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করবেন এবং সাংবিধানিকভাবে তাদেরকে ক্ষমতায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে করে দেখা যাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির আর কোনো গুরুত্ব নেই। প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী রাষ্ট্রের অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সম্পন্ন হবে, যদি এগুলো গৃহীত হয়।

ঐক্যমত কমিশনের প্রেরিত স্প্রেডশীট নিয়ে প্রশ্ন তুলে মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক প্রেরিত স্প্রেডশীট এ যে অপশন / পছন্দগুলোর ঘরে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়েছে। তাতে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়েছে, যে বিষয়গুলো প্রস্তবাকারে আসতে পারতো তা প্রস্তাব না রেখে লিডিং কোয়েশ্চন আকারে হ্যাঁ, না, উত্তর দিতে বলা হয়েছে। যেমন, প্রস্তাবগুলো গণপরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন চাই কি না? হ্যাঁ অথবা না বলুন। কিন্তু প্রথমে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে, গণপরিষদের প্রস্তাবে আমরা একমত কিনা? একইভাবে ‘গণভোট’, ‘গণপরিষদ এবং আইন সভা’ হিসাবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন চাই কিনা ইত্যাদি হ্যাঁ - না বলুন।

তিনি বলেন, সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার’ (প্রিয়ামবেল) মত অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশে থাকলেও তা স্প্রেডশীটে উল্লেখ করা হয়নি। স্প্রেডশীটে ৭০টির মত প্রস্তাব উল্লেখ করা হলেও মূল প্রতিবেদনে সুপারিশ সংখ্যা প্রায় ১২৩টির মত। একইভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মূল প্রতিবেদনে ১৫০টির মত সুপারিশ তুলে ধরা হলেও স্প্রেডশীটে মাত্র ২৭টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশই সংবিধান সংস্কারের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই আমরা মনে করছি- স্প্রেডশীটের সাথে মূল সুপারিশমালার উপর আমাদের মতামত সংযুক্ত করে দিলে বিভ্রান্তি এড়ানো যাবে।

চাটার অফ রিফর্ম তৈরি হতেই পারে মির্জা ফখরুল বলেন, সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো, জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, জনসাধারণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এবং জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা। সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করা। সংস্কার আগে না নির্বাচন পরে, কিংবা নির্বাচন আগে না সংস্কার পরে এ ধরনের অনাবাশ্যক বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একই সাথে চলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি চাটার অব রিফর্ম (সংস্কার সনদ) তৈরি হতেই পারে, নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে যা বাস্তবায়ন করবে।

সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এমতাবস্থায় এখন অন্তর্বর্তী সরকারের মূলত করণীয় হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করা। নির্বাচিত সরকার জনগণের কাংখিত ঐক্যমত্যের সংস্কারসমূহ সম্পন্ন করবে। কেননা জনগণের নিকট দায়বদ্ধ এবং ন্যায় বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য সংস্কার সম্পাদন সম্ভব।

কোনো কোনো উপদেষ্টার কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন রেখে মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করার নানা প্রকার লক্ষণ ও প্রমান ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে যা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

তারেক রহমান ফিরবেন কবে : তারেক রহমান কবে ফিরবেন এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, উনার ফেরার বিষয়ে আমরা এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ নির্ধারণ করিনি। আমাদের যখন মনে হবে যে, উপযুক্ত সময় সেই সময়ে তিনি (তারেক রহমান) আসবেন।

সর্বশেষ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ গত ২০ মার্চ বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির হত্যা মামলার আসামী সাফিয়াত সোবাহান সানভীরকে দায়মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২১ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের মামলায় তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আটজনকে খালাস দেয়। এই মামলার মধ্য দিয়ে সবগুলো মামলায় নিষ্পত্তি হওয়ায় তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো আইনি বাধা নেই বলে তার আইনজীবী জানায়।

আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী এক-এগারো সরকার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তারেকের বিরুদ্ধে প্রায় ৮৪-৮৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, অবৈধ সম্পত্তির মামলা, সিঙ্গাপুর মানি লন্ডারিং মামলা, নড়াইলে মানহানির মামলা এবং ঢাকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা।

এক এগারোর সরকারের সময়ে গ্রেফতারের পর তারেক রহমানের ওপর পুলিশ রিমান্ড ও কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চালানো হয়। একটানা ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাবাস করতে হয় তাকে। এরপর ১২টি মামলায় জামিন পেয়ে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের জামিনে তিনি পিজি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি পান এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারকে নিয়ে লন্ডনে যান তারেক রহমান।