স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর : বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উপর হামলার ঘটনার জেরে উত্তাল হয়ে উঠেছে গাজীপুর। হামলার প্রতিবাদে শনিবার দিনভর শহরে বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে আল্টিমেটাম ঘোষণা করা হয় সমাবেশে। তারা দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে অবস্থান সমাবেশ করেছে। তারা হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানায়।

স্থানীরা জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাবেক মন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের ধীরাশ্রম এলাকার গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায় প্রায় ১০০-১৫০ জন যুবক। তারা বাড়িতে ভাংচুর করতে থাকে। এসময় স্থানীয় সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কর্মীরা তাদের ঘিরে ফেলে। একই সময়ে গ্রামে ডাকাত হামলা চালিয়েছে বলে ডাকচিৎকার শুরু করে এবং মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে গ্রামবাসীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারা ১৬/১৭ জনকে আটক করে বেধড়ক মারধর করে। এতে আহত হন তারা। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং গুরুতর আহত ১৫ জনকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ৫ জনকে ঢাকার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, মহানগরীর ধীরাশ্রমের দক্ষিণখান এলাকাস্থিত সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে- এমন খবর পেয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ১৫-২০ জন ছাত্র লুটপাট প্রতিহত করতে দ্রুত সেখানে যান। তারা সেখানে গিয়ে লুটপাটকারীদের বাধা দেন। এ সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের ঘিরে ফেলে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কর্মীরা। তাদের হাতে রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র ছিল। তারা ১৫-১৬ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে বাসার ছাদে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে। পরে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে গেলে তাদেরকেও পেটায় তারা। এসময় এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তারা ডাকাতির কথা বলে মাইকে ঘোষণা দিয়ে শত শত লোককে সেখানে জড়ো করে। গুরুতর আহত ১৫ জনকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ৫জনকে ঢাকার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আহতদের দেখতে ও খোঁজ খবর নিতে শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম হাসপাতালে আসেন।

এদিকে এ ঘটনায় শনিবার উত্তাল হয়ে উঠে গাজীপুর। হামলা ও মারধরের ঘটনার প্রতিবাদে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে সকাল হতে দিনভর শহরে বিক্ষোভ শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা।

জাতীয় নাগরিক কমিটির বিক্ষোভ ও সমাবেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার উপর হামলার প্রতিবাদে গাজীপুরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর জেলা শহরের ভাওয়াল রাজবাড়ী মাঠে জাতীয় নাগরিক কমিটির গাজীপুর জেলা ও মহানগর শাখার আয়োজনে এ বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশে বক্তারা আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে খুনি ও ফ্যাসিবাদীদের দ্রুত বিচার আইনে বিচারের দাবি জানান। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পদ জব্দ করতে হবে। ছাত্র জনতার উপর হামলার ঘটনায় দায়ীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। এসময় বক্তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগেরও দাবি জানান। এছাড়াও দায়িত্বে অবহেলার কারণে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের অপসারণ দাবি করা হয় ওই সমাবেশ থেকে।

সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সংগঠক অ্যাডভোকেট আলী নাসের খান, অ্যাডভোকেট সাকিব, কেন্দ্রীয় সদস্য এম শুয়াইব, গাজীপুর মহানগরের গাছা থানা ইউনিটের সদস্য মাস্টার আনিসুর রহমান, কালিয়াকৈর ইউনিটের সদস্য সুমন বারী, ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নাবির ইউসুফ প্রমুখ।

পরে বিকলে ভাওয়াল রাজবাড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের রোডে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে থাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা। এতে বিকেলে এসে যোগ দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে ছাত্রজনতা বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে। তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি খুনি হাসিনার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো গাজীপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সন্ত্রাসীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো আমার যোদ্ধাদেরকে হুমকি দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা-পুলিশ আজ রাতের মধ্যে হামলার সাথে জড়িত খুনিদের যদি গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদেরকেও তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। বিগত দিনগুলোতে আমরা গ্রেপ্তার গ্রেপ্তার খেলা দেখতে পেয়েছি। একদল গ্রেপ্তার করে, দুইদিন পর আদালত বিচারক নামের কিছু অকালকুষ্মান্ড, যারা খুনি হাসিনার দোসর তাদেরকে জামিন দিয়ে দেয়। আমরা স্পষ্ট করে বলি হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টসহ প্রত্যেকটা জেলা থেকে ওই খুনির দোসর বিচারকদের অপসারণ করতে হবে। টাকার বিনিময়ে উপঢৌকনের বিনিময়ে অনেক দাগি আসামীদের জামিন দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট করে বলি আজকের পর থেকে যদি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কোন ক্যাডার আমার ভাইদের কোন হুমকি দেয় তাহলে পরদিন চরম পরিণতি হবে। তিনি বলেন, আমার কোন ভাইয়ের গায়ে যদি একটা দাগ লাগে, তাহলে সেই দাগ প্রশাসনের চেয়ারে এসে লাগবে। সকালে প্রশাসনের সাথে বৈঠক হয়েছে। সেখানেও বলে এসেছি গ্রেপ্তার খেলা বন্ধ করেন। এসব সন্ত্রাসীদেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য নতুন এক অপারেশন চালাতে হবে। বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের বের করতে হবে।

সমাবেশে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ দেশের সম্পদ পাচার করেছে। তারা জানত, দিন শেষে তারা এ দেশে থাকবে না। তাই তারা ২৬০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে। কিন্তু আমাদের এ দেশেই থাকতে হবে। তাই দেশের সম্পদ আমাদের, এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আমাদেরই।

তিনি বলেন, "পুলিশ আমাদের প্রতিশ্রুতি ও নিশ্চয়তা দিয়েছে, তাই আমরা পুলিশকে সহযোগিতা করতে চাই। তবে সহযোগিতার অর্থ এই নয় যে, পুলিশ মামলা বাণিজ্য করবে, আজ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করবে আর কাল জামিন দিয়ে দেবে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ‘সাবেক আওয়ামী লীগ নামে কিছু নেই; এরা গণহত্যাকারী। সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেও কিছু নেই, মোজাম্মেল হক একজন গণহত্যাকারী।

গাজীপুরের কমিশনার যেহেতু আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র ও নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করছে, তাই আমরা তার এই কমিটমেন্টের প্রতি আস্থা রাখছি। তবে আমরা পর্যবেক্ষণ করব।

পরে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার ড. মোহাম্মদ নাজমুল করিম খান বলেন, গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ী সড়কে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এ ঘোষণা দেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার নাজমুল করিম খান।

বিক্ষোভে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘গতকাল রাতে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার জন্য আমি দুঃখিত। পুলিশের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমাদের ব্যর্থতা স্বীকার করছি। হামলাকারী কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, প্রতিটি হামলার জবাব দেওয়া হবে। যেসব পুলিশ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, "আমি শুনেছি, আমার ওসি দুই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন। এ জন্য তাঁকে সাসপেন্ড (বরখাস্ত) করা হবে। পুলিশ বাহিনীতে যারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আঁতাত করেছে, তাদের চাকরিতে রাখা যাবে না।

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং রাতে চিরুনি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দমন করতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হবে।

গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ঘটনার পর গাজীপুরে রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গাজীপুরে ডিসি অফিসের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীকে গুলী

গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে মোবাশশির হোসাইন নামে এক ছাত্র আন্দোলন কর্মী আহত হয়েছেন। তিনি গাজীপুর জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। সে মহানগরের দক্ষিণ হাড়িনাল এলাকার আলী আহমেদের ছেলে।

মোবাশশির হোসাইন জানান, গাজীপুরে তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ করার পর আহত ছাত্রদের দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সে সময়, একটি মোটরসাইকেল থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলী চালানো হয়। এতে তার ডান হাতে গুলী লাগে।

গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মোবাশশির জানান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ঘটনায় গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে অবহিত করা হয়েছে।

মোবাশশিরকে চিকিৎসার জন্য তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিসৎ ডা. মঞ্জুর মোরশেদ জানান, মেবাশির হাতে গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আসে। তাকে ভর্তি দেয়া হয়েছে। তার হাত থেকে গুলী বের করার জন্যে ওটিতে নেয়া হয়েছে।

কারা এই হামলার পেছনে রয়েছে এবং কী উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। ঘটনার পর গাজীপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।