২৮ মে রাজধানীতে ্এক সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, হতে হবেই। অন্যদিকে ঈদুল আজহার আগেরদিন রাতে জাতীর উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এপ্রিল মাসের প্রথম দিকের যে কোনো দিন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ঘিরে সরকার ও বিএনপির এমন ঘোষণার ফলে উত্তপ্ত হয়ে উঠে দেশের রাজনীতির মাঠ। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একটাই বক্তব্য ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। এমনকি তাদের কেউকেউ বলেছেন, সরকার যদি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না করে তাহলে তারা নিজেরাই সিডিউল ঘোষণা করবেন। তবে এতদিন ধরে ডিসেম্বরের মধ্যেই যে নির্বাচনের দাবি করছিল সেটি থেকে সরে এখন রমযানের আগে নির্বাচনের কথা বলেছেন দলটির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান। গতকাল শুক্রবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন দাবি জানান তারেক রহমান। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যদি সংস্কার ও জুলাই সনদসহ সার্বিক কার্যক্রম ঠিকমত সম্পন্ন হয়, তাহলে রমযানের আগে নির্বাচন হতে কোনো সমস্যা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে রমযানের আগে নির্বাচনের দাবি জানানো হলেও ঘুরে ফিরে ‘যদি-কিন্তু’ র মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সূত্র মতে, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই সময়সীমা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের টাইম ফ্রেম ঘোষণার আগ থেকেই বিএনপি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। ফলে এই সময়সীমায় খুব একটা সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। তবে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমাকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের অধিকাংশ রাজনীতিক দল। অন্যদিকে গত মাসে ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে তারেক রহমান স্পষ্টভাবেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে।’ বিএনপির এমন অনড় অবস্থানের মধ্যেই গত ছয়ই জুন ঈদুল আজহার আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানেই তিনি ঘোষণা করেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন। এপ্রিলে নির্বাচন হলে বিএনপির অবস্থান কী হবে প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, তারা তাদের আগের অবস্থানেই অনঢ়। ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থানের মধ্যেই লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গতকাল বৈঠক করেছেন তারেক রহমান। প্রশ্ন উঠেছিল, এই বৈঠকের পর কী তাহলে বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে? হয়েছেও তা-ই। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের এই বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের দাবি করা হয়েছে। যদিও গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, আমরা আশা করছি, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সরকার এটা বিবেচনা করবেন। সময়টা তো ঠিক না। রোজার মাস, ঈদ শেষ হবে, তার কয়েকদিন পরেই নির্বাচন। রোজার সময় নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে প্রার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্ভোগ হবে। আমি তো এখন থেকেই উদ্বিগ্ন যে আমাকে প্রতিদিনই ইফতার পার্টি করতে হবে। এতে নির্বাচনের ব্যয়টাও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। গরমে দিনের বেলায় জনসভায় লোকজন কিভাবে আসবে। রাত্রে গিয়ে মিটিং করতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্যই এই বৈঠকে নির্বাচন প্রশ্নে তৈরি হওয়া সংকট সমাধানের আশাও দেখছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মারুফুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু থাকে না। রাজনীতিতে যে কোন সম্ভাবনাই থাকে। প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যে সংকট রয়েছে সেটার আপাততভাবে খানিকটা নিরসন হয়েছে। তারপরও রোজার আগে নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি-কিন্তু রয়েই গেছে। সব কিছু সংষ্কারসহ অন্যান্য ইস্যু বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করছে। তবে বৈঠকটিকেই আগামীর রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণী বলেই মনে করছেন এ বিশ্লেষক।

সূত্র মতে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কবে হবে? বলা যায় এ নিয়ে ‘টাগ অব ওয়ার’ চলছিল রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টা প্রথম থেকেই বলে আসছেন, নির্বাচন হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে। তার কথার নড়চড় হয়নি এখনো। একইসাথে জাপান সফরে প্রধান উপদেষ্টা এক বক্তৃতায় বলেছেন, কিছু ব্যক্তি সংস্কার রেখে নির্বাচন শেষ করতে বলছেন এবং সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইছে। এই টানাপোড়েনের মধ্যে ২৮ মে নয়াপল্টনে এক জনাকীর্ণ সমাবেশে ভার্চুয়ালি তারেক রহমান বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। আবারও আমরা বলতে চাই, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন।

জানা গেছে, বিএনপি ঘোষিত নির্বাচনী মাসের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেনি দেশের অধিকাংশ রাজনীতিক দল। তারা বলছে, সংষ্কার, ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার, জুলাই সনদ সম্পন্ন হবার পরেই নির্বাচন হতে হবে। কোনো একটি দলের দাবিতে নির্বাচনের আয়োজন করা যাবে না। এছাড়া অনেকেই বলছেন, বিএনপি নির্বাচনের সময় ঘোষণার দাবিতে বড় বড় জনসভা করলেও সেগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ত আমজনতার উপস্থিতি নেই। বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচনের দাবিতে সাধারণ নাগরিককে তাদের ব্যানারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নামাতে পারেনি। নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ের প্রশ্নে বিএনপি জনতার মধ্যে সেই আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রদের রাজনৈতিক দল, প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন এমন সাড়ে চার কোটি ভোটার ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়িয়ে বিএনপি একাই যদি নির্বাচনের আগাম সময় নিয়ে বাড়তি চাপ তৈরি করে, তবে একটা বড় রাজনৈতিক বিভাজনের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এছাড়া বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের চাপকে যদি ভারত-বিএনপি যোগসূত্র বলে প্রচারণা বাড়তে থাকে, সেটাও বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে। নতুন ভোটার ও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সেখানে বিএনপির দূরত্ব বাড়তে পারে। একইসাথে নির্বাচনের সময় ঘোষণায় মাঠ দখল নিয়ে বিএনপি যদি লাগাতার রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সামগ্রিকভাবে অচল করে দিতে চায়, তাহলে সরকারের সমর্থক দেশি-বিদেশি মহলের বিরাগভাজন হয়ে উঠতে পারে বিএনপি। সমঝোতা ছাড়া শুধু চাপ প্রয়োগের রাজনৈতিক কৌশল সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাকেও বিপদগ্রস্ত করতে পারে। ফলে দলটি এখন রমজানের আগে নির্বাচনের যে দাবি জানিয়েছে সেটি অনেকটা ইকিবাচকই হবে বলে মনে করছেন সবাই।

লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকটি সত্যিকার অর্থে একটি টার্নিং পয়েন্টে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এই বৈঠকের পর একটি যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, দুই নেতার বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, বৈঠকের আলোচনা বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান ছিল আগামী নির্বাচনের ইস্যু। সেখানে তারেক রহমানের প্রস্তাব ছিল, আগামী এপ্রিলে নির্বাচনের যে তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা উপযুক্ত সময় নয় বিধায় এগিয়ে নিয়ে আসা। সেখানে জাতি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা সম্মত হয়েছেন, তারা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আগামী নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন।

এদিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, আগামী রমযানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে যে ফলপ্রসূ ঐকমত্য হয়েছে, তা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশের মানুষের জন্য এনেছে স্বস্তির বার্তা, নতুন আশার আলো। পুরো বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সংযোগ ঘটিয়ে, এপ্রিলের মতো অনাকাক্সিক্ষত সময় থেকে সরে এসে নির্বাচনের জন্য একটি যৌক্তিক সময়সীমা নির্ধারণের জন্য প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। তিনি জনগণের প্রত্যাশা উপলব্ধি করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।

বিএনপি মহাসচিব ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণের যে কথা বলছেন সেটি অবশ্য যৌথ ঘোষণায় দেখা যায়নি। বৈঠকের পর দুই পক্ষের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারেক রহমানের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালে পবিত্র রমযান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। এই যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জনের কথা বলা হয়েছে।

লন্ডনে বৈঠক শেষে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নির্বাচনের একটি সঠিক তারিখ নির্ধারণে আসলে সমস্যাটা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর দেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, এর কোনো সমস্যাই নেই। আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না, কেউ দেখলে এটা ভুল দেখছেন। নির্বাচনের বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা আরও বলেন, যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার, দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব। এসময় খলিলুর রহমানের কথার সঙ্গে আমীর খসরু একটি বাক্য যুক্ত করে বলেন, ‘সম্পন্ন করা যাবে। এপ্রিলে ঘোষিত যে নির্বাচনের রূপরেখা, সেখান থেকে সরকার কিছুটা সরে আসতে চাচ্ছে বা আসবে? এর উত্তরে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।