মতের ভিন্নতা থাকলেও জাতীয় স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ সময় অনেক পরাশক্তি ও এজেন্সি নানা ষড়যন্ত্র করবে, ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গঠনে অনেক বাধাই আসতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচনের দিকে যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তা এগিয়ে নিতে হবে। গতকাল রোববার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গণঅধিকার পরিষদের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার নির্বাচনকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন পরাশক্তি ও এজেন্সি সক্রিয় হবে বলে সতর্ক করে বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে পরাশক্তি ও অভ্যন্তরীণ শক্তি নির্বাচন ও নতুন দেশ গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিকে যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তা এগিয়ে নিতে হবে।

তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের বিদায়ের জন্য আমরা যে লড়াই করলাম, আমরা ভেবেছিলাম একটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের পূরণ হবে। সুশাসন পাব। বাধাহীন পরিবেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক নেতারা মতপ্রকাশের সুযোগ পাবে। রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। ছাত্রসংগঠন অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ভোগ করবে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার অতি সম্প্রতি এই নুরুল হক নুরের ওপর আবার কীভাবে, ফ্যাসিবাদ মুক্ত একটা সমাজে আবার নির্যাতন করা হয়েছে, সেটা দেখে জাতি স্তম্ভিত হয়েছে। তিনি অসুস্থ, তার চলাফেরা, হাঁটতে দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি স্বাভাবিক নয়। দেশের বাইরে তিনি চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তার সুস্থতা, সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। এই মজলুম নেতাকে ঘিরে গণঅধিকার পরিষদের মূল সংগঠন, অঙ্গ সংগঠন পার্শ্ব সংগঠনের বিপ্লবী কর্মীরা যেভাবে এ সংগঠনের অকুতোভয় অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখেছেন, সেজন্য জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আমি তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচনের যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, সেই অভিযাত্রা যেন আবার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য জাতীয় ঐক্যের যে দৃষ্টিভঙ্গিতে জুলাই চেতনা আমরা ধারণ করেছি, সেই চেতনাও যেন আমরা ধারণ করতে পারি। অনেক পরাশক্তি, দেশের ভেতরে নানা এজেন্সি সক্রিয় হবে।

জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ, একটি নতুন বাংলাদেশ, একটি মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অনেক বাধা আসবে। সেজন্য রাজনৈতিক মত-পথের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা যেন দেশ গঠনের মূল ইস্যুতে ঐক্য ধরে রাখতে পারি। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক মত-পথের ভিন্নতা থাকলেও জাতীয় স্বার্থে দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কোনভাবেই আইনানুগ প্রক্রিয়ার বাইরে না যাবার পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যাই সিদ্ধান্ত হোক না কেন সেটা যেন সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে না হয়। আমরা যেন এই জাতিকে একটি সুষ্ঠ নিয়মতান্ত্রিক ধারার মধ্যে দিয়ে পরিচালনা করি। সালাহ উদ্দিন বলেন, জুলাই হচ্ছে জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক সমঝোতার একটি ঐহিতাসিক পূর্ণাঙ্গ দলিল। যা বাস্তবায়নের জন্য আমরা সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ এবং সেই বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ফোরাম হচ্ছে একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। এখানে কোন দলের সেই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। সেই জাতীয় সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যাতে জাতীয় সংসদ বাধ্য থাকে সেই একটা আইন ভিত্তি করতে এখন সেই প্রস্তাব জাতীয় সংসদের কাছ থেকে প্রস্তাব অথবা সুপারিশ সরকারের কাছে দেয়া সেই সুপারিশটা দেয়ার পরেই আমরা জানতে পারবো কি প্রক্রিয়ায় সেই আইনটা রচনা করতে চাচ্ছে।

তিনি বলেন, সকল রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই আমরা যেন কোনভাবেই আইনানুগ প্রক্রিয়ার বাইরে না যাই, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে না যাই। কারণ অনেকেই আবেগের বশবর্তী বলে থাকেন যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে জনগণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে, সে অভিপ্রায়ের অবনতি ঘটবে বলে অনেক কিছু বৈপ্লবিক আদেশ জারি করা যায়। এই বক্তব্য হচ্ছে আবেগের বক্তব্য। কারণ জনগণের অভিষয়কে বাস্তবায়ন করার জন্যেই আমরা সবাই সংবিধানের আশ্রয় নিয়েছি এবং সাংবিধানিকভাবেই এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছি এবং এখনো পর্যন্ত আইনানুগভাবে সাংবিধানিকভাবে আমরা এই রাষ্ট্রটা পরিচালনা করছি।

সালাহ উদ্দিন বলেন, এখানে কিছু কিছু বিষয়ের মধ্যে অনেকে বিতর্ক নিয়ে আসেন, প্রকৃত সাংবিধানিকতাকে কী রক্ষা করা গিয়েছে? আমরা সবসময় উত্তর দিয়েছি। যত কিছু আমরা সংবিধানের ১০৬ মধ্য দিয়ে আমরা বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা সেই প্রোফাইল নিয়ে যেন আবার এমন কোন অসাংবিধানিক পদ্ধতির দিকে না যাই যাতে ভবিষ্যতে এটা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠে যে, যার আদেশ জারি করার কথা তিনি করলেন না। যেভাবে আদেশ জারি করার কথা সেভাবে বলো না, সেই আদেশের ভিত্তি যদি আইনানুগ না হয় তাহলে সেই আদেশের আইন কিভাবে রচিত হবে এবং সেটাকে বাস্তবায়নের জন্য কিভাবে আবার পার্লামেন্টকে নেবেÑ একথাগুলো যেন আমরা বলি।

এনসিপি প্রসঙ্গে সালাহ উদ্দিন বলেন, আমার ভাই যারা নতুন রাজনৈতিক দল করেছেন-এনসিপি, তাদের অনেক রকমের বক্তব্য আছে যেগুলো আমরা নিজেরাও ধারণ করি। কিন্তু সেগুলোকে একটা বাস্তব রুপ দিতে হবে এবং বাস্তবের নিরিখে কথা বলতে পারি, আমরা যেন এমন কোন প্রস্তাব না দেই যাতে করে ভবিষ্যতে সেই প্রস্তাবগুলো সে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেউ জুডিশিয়ারের কাছে নিয়ে যেতে চায় এবং সেগুলোর মধ্যে দিয়ে যা আমাদের এই টোটাল প্রক্রিয়াটাকে কেউ একসময় অবৈধ বলে যেন আওয়াজ না দিতে পারে এগুলো আমি আজকের জন্য বলছি না, আগামী পাঁচ বছরের জন্য বলছি না, আগামী ১০ বছর পরে বা ১৫ বছরে যাতে এই প্রশ্নটা নিয়ে কেউ আদালত না যেতে পারে সেরকম একটা ভিত্তি আমাদের এখনই রচনা করতে হবে।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য সমুন্নত রাখতে হবে মন্তব্য করে সালাহ উদ্দিন বলেন, আমরা চাই, আমরা সবাই যেমন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, যেভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে ফেসিবাদের পতন হয়েছে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে সেইরকম ঐক্য যেন আমরা বজায় রাখি। এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যই হবে আমাদের সামনে ফিরে এগিয়ে চলে চলার একমাত্র শক্তি। আর যদি সেই ঐক্য কোন কারণে আমাদের মধ্যে নষ্ট হয় তাহলে সেটা ফ্যাসিবাদকে ভিন্নভাবে টেনে নিয়ে আসবে।

অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্ত করলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। রাস্তায় আন্দোলনের নামে সংঘর্ষের রাজনীতি করলে আবার শেখ হাসিনার আমলে ফেরত যেতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিভেদ নেই, সব দলের নিজস্ব রীতিনীতি থাকে, সবাই সবার মতো মত দেবে, এটাই গণতন্ত্র। যার যার এজেন্ডা নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ারও পরামর্শ দেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, দ্বিমত পোষণ করেও ভিন্নমতকে সম্মান জানানো যায়। পাশাপাশি, সাংঘর্ষিক ও হিংসাত্মক রাজনীতিতে ফেরত যাওয়া যাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেউ যেন অংশ নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় পার্টি (জাপা) মানে আওয়ামী লীগ। জাপার ভোটে অংশ নেওয়া মানে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়া। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদ বানিয়েছে জাতীয় পার্টি। জাপার নেতাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। কারো দলীয় স্বার্থে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দেয়া গেলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

আখতার হোসেন আরও বলেন, গণঅধিকার পরিষদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ সবাই যে কঠিন মুহূর্তটা আমরা পারছিলাম, এখানে অনেকেই আমার সহযোদ্ধারা আছেন, যাদের সঙ্গে আমি একসঙ্গে জেল খেটেছি, অনেক সহযোদ্ধাই আছেন যাদের সঙ্গে একসাথে রাজপথে মিছিল দিয়েছি। স্লোগান ধরেছি। আমি আক্রান্ত হলে পরে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আজকে যারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তারা অনেকেই সেই মিছিলে অংশ নিয়েছেন। আমি গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সেই উত্তাল সময়ের দিনগুলো অনুভব করি। সেই দিনগুলোকে আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে দেখে যাব আজীবন। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নির্বাচন ছাড়া সংস্কার বাস্তবায়িত হবে না। বিপ্লব করলেও শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্ট লাগে, একটা সংসদ, একটা সংবিধান কিংবা যেকোনো কিছুকে বৈধতা দিতে। একটা জনপ্রতিনিধির মধ্য দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়। কাজেই আগামী সংসদের নির্বাচন ছাড়া আমরা এই পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে পারব না। আমরা আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়ে একমত হয়েছি।

সভাপতির বক্তব্যে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হল নুর বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির বিষয়ে ফয়সালা হওয়া দরকার। তিনি বলেন, নির্বাচন বিঘিœত হোক আমরা এমন কোনো কাজ চাই না। কিন্তু জাতীয় পার্টির বিষয়ে ফয়সালা না হয়ে যদি আমরা নির্বাচনে যাই, তাহলে আমাদের জন্য শনির দশা অপেক্ষা করছে। এই জাতীয় পার্টির মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ ব্যাক করবে। নুর বলেন, যেসব এলাকা একটু আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিত, ওইসব এলাকায় জাতীয় পার্টির মাধ্যমেই তারা নির্বাচনে নাশকতা করতে চেষ্টা করবে। আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনকে কলঙ্কিত করতে চেষ্টা করবে। কাজেই জাতীয় পার্টির বিষয়ে নির্বাচনের আগে আমাদের একটা ফয়সালায় যাওয়া দরকার। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেই জিএম কাদের একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি কীভাবে এই দুঃসাহস দেখাতে পারেন এবং বলতে পারেন আওয়ামী লীগ ছাড়া নাকি এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এই কথা বলার পর জিএম কাদের কীভাবে এই ঢাকার রাজপথে তার অফিসে আসেন, তার উত্তরার বাড়িতে অবস্থান করেন।

গণঅধিকার পরিষদের এই শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা চাই আগামীর বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় গড়ে উঠবে। আগামীর বাংলাদেশে হানাহানি, মারামারি ও বিভাজন থাকবে না। আমরা সবাই চাচ্ছি যে, নির্বাচন যথাসময় হোক। রাজনৈতিক নেতাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে। এই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-যুবক-তরুণরা আন্দোলন করেছেন। তারা আহত হয়েছেন, গ্রেপ্তারও হয়েছেন। একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদেরও কিন্তু প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফারুক খানের সঞ্চালনায় এই আলোচনা সভায় বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, গণ অধিকারের সেক্রেটারি রাশেদ খানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।