বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত এবং কারিগরিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারিদের চাকরি জাতীয়করণ এবং স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন নামে একটি শিক্ষক সংগঠন। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে তাদের মূল দাবি মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত ২৫ দফা দাবি মেনে নিতে আহ্বান জানান তারা। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছেন, চাঁদাবাজ যেখানে আছে আমাদের সংগ্রাম হবে সেখানে। আগামী দিনে যেন কোনো চাঁদাবাজ চাঁদাবাজি করতে না পারে। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। দলমত দেখে নয়, যেখানে চাঁদাবাজি করতে দেখা যাবে সেখানেই জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
গতকাল সোমবার বিকেলে প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের শিক্ষকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তারা এই দাবি জানান। বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রফেসর ড. এম কোরআন আলীর সভাপতিত্বে এবং বাআশিফের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক রবিউল ইসলামের সঞ্চালনায় উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন-বাআশিফের উপদেষ্টা, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ও অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন-বাআশিফের জেনারেল সেক্রেটারী অধ্যাপক এবিএম ফজলুল করিম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদের সেক্রেটারি ড. মো. রফিকুল ইসলাম, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ ও সেক্রেটারি ড. আব্দুস ছবুর মাতুব্বর, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা শাহজাহান মাদানী ও সেক্রেটারি মাওলানা মুফতি ফারুক আহমেদ, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নুর নবী মানিক ও সেক্রেটারি আজম কামাল উদ্দিন ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, যারা চাঁদাবাজি করতে গেলো, তারা তথাকথিত শিক্ষিত দাবিদার। কিন্তু তাদের চরিত্র ঠিক নেই। দেশে চরিত্রবান শিক্ষিত মানুষ প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে শিক্ষানীতি এটা মানুষের জন্য নয়, এটা পশুর জন্য। এখন মানুষ নামের পশু তৈরি করা হচ্ছে। এসময় ফেডারেশনের দাবির সাথে সহমত পোষণ করেন তিনি। সরকারকে আহ্বান জানান তাদের দাবি মেনে নিতে। শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দের দাবিও জানান তিনি।
প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি যে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দেশের শিক্ষা খাত এখনো দৃশ্যমান কোনো মৌলিক সংস্কার করেনি। শিক্ষা খাতে বৈষম্য, অবহেলা ও বিশৃঙ্খলা অনেকাংশে পূর্বের ন্যায়ই বহাল রয়েছে। শিক্ষকদের প্রতি অব্যাহত বঞ্চনা, স্বীকৃতিহীনতা, প্রায় বেতনহীন চাকরি, মূল্যায়নের অভাব এবং প্রশাসনের গড়িমসি গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রফেসর ড. এম কোরআন আলী বলেন, বর্তমানে শিক্ষা খাতের যে সংকট, তা জাতীয় জীবনের ভিত্তি আদর্শ বিনষ্ট করছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ও এর সৃষ্ট বিতর্কিত শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে দেশে ঈমান আকিদা বিরোধী, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধহীন প্রজন্ম তৈরির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্হান স্পষ্ট। বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে একটি গঠনমূলক ও অংশগ্রহনমূলক শিক্ষা সংস্কার দাবি করে আসছে।
সাংবাদিক সম্মেলন থেকে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহবান জানানো হয়। নিম্নে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো তুলে ধরা হলো- বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত এবং কারিগরিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরী জাতীয়করণ এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন করতে হবে। চাকুরী জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত নিম্নের দাবীগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। ১. শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ উৎসব বোনাস, সরকারি নিয়মে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। ২. প্রাথমিকে ২০২৬ সাল থেকে ধর্মীয় শিক্ষা চালু এবং ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বেতন-ভাতা নবম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ১০ম গ্রেডে প্রদান করতে হবে। ৩. শিক্ষার সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা চালু করতে হবে এবং সকল শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিরোধী বিষয় বাদ দিতে হবে। ৪. পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের জন্য সকল স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যব¯’া করা ও গবেষণা কর্মের সুযোগ দেয়া এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলীর ব্যব¯’া করা। ৫. সচল স্বীক...তি প্রাপ্ত সকল নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তির গেজেট ঘোষণা করে আগস্ট মাস থেকে বেতন ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. বেসরকারি কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষকদের ৮ বৎসর পূর্ণ হওয়ার পর অটো সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া এবং সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করতে হবে।
৭. বৈষম্যের শিকার ও চাকুরিচ্যুত, সাময়িক বরখাস্ত ও বিতাড়িত সকল শিক্ষক-কর্মচারীকে স্ব-স্ব কর্ম¯’লে পূণর্বহাল ও বকেয়া বেতনভাতা, অবসরকালীন সকল পাওনা পরিশোধ করা এবং অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ভাতাসহ সকল পাওনাদি প্রাপ্তির বিষয়ে সরকারিভাবে নির্বাহী আদেশ প্রদান করতে হবে।
৮.সৎ ও যোগ্য শিক্ষকদের সমন্বয়ে অবিলম্বে অবসর সুবিধাবোর্ড ও কল্যাণ ট্রাষ্টের কমিটি গঠন করতে হবে। ৯.প্রতিটি উপজেলায় অবিলম্বে একটি করে ফাজিল ও জেলায় কামিল মাদরাসা সরকারিকরণ করতে হবে। ১০. কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজিকরণ ও সকল শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যব¯’া করতে হবে। ১১.নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষাব্যব¯’া প্রণয়ন করার লক্ষ্যে অবিলম্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সপ্তাহে একদিন মাঠ পর্যায়ে কিংবা শিল্প কলকারখানায় শ্রমের শিক্ষা দেওয়া এবং পার্ট টাইম ইন্টার্নিশীপের সুযোগ প্রদান করতে হবে। ১২. ভোকেশনাল শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মূল ধারায় যুক্ত করে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কারিগরি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকরণ সহজ করতে হবে। ১৩. দেশীয় প্রযুক্তিকে উন্নত করার মাধ্যমে মেধাবীদের মূল্যায়নের পাশাপাশি দেশের বেকারত্ব দূর করার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষনের এবং বেকারদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসং¯’ানের ব্যব¯’া করতে হবে। ১৪. শিক্ষার সকল স্তরের পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় ও নৈতিকতাবোধের আলোকে এবং ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে হবে। ১৫. সকল শ্রেণিতে মহানবী (সা:) এর জীবনীসহ মহামানবদের জীবনী সম্বলিত প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার সংযোজন করতে হবে। ১৬. কওমী মাদরাসা শিক্ষার স্তরগুলোকে সাধারণ শিক্ষার সমমান দেওয়া। কওমী মাদরাসাসমূহের সকল বোর্ডকে একটি বোর্ডে রুপান্তর এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব অনুষদের মাধ্যমে বিষয় ভিত্তিক মাস্টার্সের সার্টিফিকেট প্রদান করা। ১৭. ধর্মীয় দায়িত্ব পালন ও মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহের লক্ষ্যে স্কুল, কলেজসমূহে ধর্মীয় বা আরবী ভাষা শিক্ষক হিসাবে এনটিআরসিএ দ্বারা নিয়োগ প্রদান করতে হবে। ১৮. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ী মনোভাব দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেমন সরকারি খাস জমি বরাদ্দ দেয়া, ইউনিভাসিটি উদ্যোক্তাদের থেকে শিক্ষা সেবা মর্মে অঙ্গীকার নেয়া এবং ওছঅঈ নিশ্চিত করা।
১৯. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন কাঠামো রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারণ করে দেয়া। ২০. স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ¯’াপন, পাঠদান অনুমতি, স্বীক...তি প্রদান এবং এমপিওকরণ নীতিমালা বাস্তবায়নে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের দীর্ঘসূত্রীতা অবলম্বন বন্ধ করতে হবে। ২১. স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা নীতিমালা ২০২৫ পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে প্রতি ৩ মাস পর পর যেসকল মাদ্রাসা এমপিও অর্জনের উপযোগিতা পূরণ করেছে তাদেরকে এমপিওভুক্ত করতে হবে। ২২. যে সকল মাদ্রাসা জাতীয়করণের শর্ত পূরণ করবে তাদেরকে নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে এমপিও ও জাতীয়করণ করতে হবে। ২৩. ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি শিক্ষক সংগঠনের শিক্ষকরা ক্লাসরুমে পাঠদান ছেড়ে তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য রাজপথে দিন-রাত তাদের দাবী পুরণের জন্য সরকারের নিকট দাবী জানিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের দাবি পূরণে সরকার কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। অথচ এই শিক্ষকরা বৃষ্টিতে ভিজে, রোদ্রে পুরে, মশার কামড় খেয়ে তারা অসুস্হ হয়ে পরছে। তাই সরকারের প্রতি আমাদের জোরদাবি এই সকল শিক্ষক সংগঠনের যুক্তি সংগত দাবিগুলো মেনে নিন। সম্মিলিত নন-এমপিও ঐক্য পরিষদ, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদসহ অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন যাবত তাদের দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য রাজপথে আন্দোলন করছে। ২৪. অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ তহবিলে ইতোমধ্যে যারা আবেদন করেছে তাদের প্রাপ্য অবিলম্বে সরকারি তহবিল থেকে প্রদান করতে হবে। ২৫. ১৭ ও ১৮ তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তির্ণ হয়েও যারা বাদ পরেছে অবিলম্বে তাদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে।