সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মতামত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে বিএনপি। গতকাল রোববার দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে বিএনপির মতামত জমা দেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেন, আমরা আজকে রোববার ৫টা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপরে বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের মতামত তারা যে স্প্রেডশীট আমাদেরকে দিয়েছেন সেটা এবং বিস্তারিত মতামত তার ওপরে দুইটিই একসাথে দিয়ে এসেছি। অন্যগুলো কয়েকদিন পরে বিস্তারিত মতামত দেবো। প্রায় যেগুলোতে একমত হওয়া উচিত সেগুলোতে একমত হয়েছি। আর যেগুলো আমাদের ভিন্নমত দেয়া প্রয়োজন সেগুলোতে আমরা মতামত সহকারে দিয়েছি। মোটামুটি আমরা পুরোপুরি সহযোগিতার মধ্যে আছি।
গতকাল দুপুর ১টায় সংসদ ভবনের এলডি ভবনে সালাহ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে বিএনপির মতামত হস্তান্তর করেন। এই সময়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ছিলেন।
ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যানের সাথে সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মুনীর হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ৬ মার্চ বিএনপিসহ ৩৭ টি রাজনৈতিক দলকে ‘চিঠি ও স্প্রেডশিট’ পাঠিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানাতে বলা হয়। রোববার পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দেয়।
গতকাল বিএনপি ছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি তাদের মতামত জবাব দেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর কয়েকটি সংস্কার কমিশনের পাশাপাশি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রধান হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, উনারা একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে একই কাতারে ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে এসেছেন, যেটা আমরা মনে করি সমীচীন নয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের অংশটি সংবিধানের অন্য জায়গায় কিভাবে চতুর্থ তফসিল যুক্ত করা যায় সেটা পরে আলোচনা করা যায়। এখানে সরকারের কোনো লেজিটেমেসির অভাব আছে বলে আমরা মনে করি না। এই সরকার সাংবিধানিকভাবেই গঠিত হয়েছে। আর্টিকেল ১০৬ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে এডভাইজারি রোল হিসেবে যেটা আছে সেটার ভিত্তিতে এই সরকার শপথ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, আমরা সবাইকে যুক্ত করেই এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সাজাতে চাই, বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো সংস্কার করতে চাই, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য বৈষম্যহীন একটি সত্যিকার সুশাসন ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য। যেখানে সবারই মর্যাদা থাকবে সাম্য থাকবে।
গণপরিষদ ও গণভোট নির্বাচন নয় উল্লেখ করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, গণপরিষদ নিয়ে অনেক বক্তৃতা দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্র হয়েছে সেখানে সংবিধান রচনা করা দরকার, রাষ্ট্রের সংবিধান নাই সেজন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিনিধিত্ব আকারে গণপরিষদ গঠন করা হয়, সেটা নির্বাচনের মাধ্যমে হতে পারে, সিলেকশনের মাধ্যমেও হতে পারে। সেই গণপরিষদ একটা সংবিধান প্রণয়ন করে এবং সেটা গৃহীত হওয়ার পরে সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়। এখানে আমাদের রাষ্ট্র কি নতুন হয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র্ পুরাতন রাষ্ট্রৃ ৫৩/৫৪ বছর। আমাদের একটা সংবিধান আছে সেই সংবিধানের হয়ত গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে তার সাথে আমরা একমত নই। যার জন্যে রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করা দরকার নতুনভাবে। সেই জন্য আমরা সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনী এনেছি। যারা গণপরিষদ দাবি করছে তারাও ৬৯টা প্রস্তাব দিয়েছে সংশোধনের জন্য আমরা একটু কম দিয়েছি। এগুলো আলোচনা করে আমরা একটা বৃহত্তর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের একটা ব্যাপক সংশোধিত সংবিধান পেতে পারি। সেই সংবিধানকে তারা নতুন সংবিধান বলতে পারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখানে গণপরিষদের কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, সংশোধিত সংবিধানকে তারা নতুন নামে ‘রিপাবলিক’ বলতে পারে আমাদের তো আপত্তি নাই। কিন্তু তাদের সেই আইডিয়াটা পুরো জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়াটা কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটা বিচারের দাবি রাখে।
সালাহ উদ্দিন বলেন, গণভোটের বিধান তো আছে সংবিধানের ১৪২ আর্টিকেলে। সেখানে বলা আছে, আর্টিকেল ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ ইটসেলফ। এগুলো যখন সংশোধিত হবে তখন গণভোটের প্রয়োজন হবে। যদি নতুন সংবিধানে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আরও কোনো প্রভিশন যদি এই গণভোটের অধিনে নিয়ে আসা হয় সেটা তখন দেখা যাবে। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে গণভোটের কথা আসতে পারে। আমরা মনে করি, এখন সংসদ নির্বাচন করা উচিত। গণভোট নির্বাচন নয়। আমরা মনে করি আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকতভাবে একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে সমস্ত আলাপ-আলোচনা সংসদে হতে পারবে।
বিএনপি সংস্কার নিয়ে কিছু মতামত তুলে ধরে। এর মধ্যে অন্যতম দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার। সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্প্রেডশীটে ২০টির মতো প্রস্তাবনা সুপারিশ ছিলো। ২০টার মধ্যে আমরা ১১টাতে সরাসরি একমত আর ৭/৮ টাতে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। শুধুমাত্র একটি প্রস্তাবে আমরা ভিন্নমত পোষণ করেছি। কারণ ওখানে একটা আইন সংশোধনের বিষয় রয়েছে.. আয়কর সংক্রান্ত।
প্রশাসন সংস্কার কমিশন : সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখানে ২৬টা বিষয়ে প্রস্তাবনা আছে। সেখানে আমরা এর প্রায় অর্ধেক বিয়য়ে একমত। আর বাকি অর্ধেক বিষয়ে আমাদের মতামত-মন্তব্য আছে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনায় একটা জায়গায় আসা যাবে। তিনি বলেন, এসব প্রস্তাবনার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কর্মকর্তাদের সচিব পদোন্নতির জন্য একটি পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেইজ থেকে সেখানে বিদ্যমান এসএসবি বাতিলের একটা সুপারিশ করা হয়েছে। এর সাথে আমরা একমত নই। তার পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করার একটা প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনে রাজনীতিকরণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেজন্য আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি।
আরেকটা বিষয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে প্রস্তাবনা দেয়া আাছে.. সে বিষয়ে আদালতের রায় আছে। আদালতের রায় বহাল থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে আমরা কোন মন্তব্য করতে চাইনি। আমরা স্টেটাসকো(স্থিতিবস্থা) রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করি।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন : কমিশনের প্রায় সকল প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত। যেহেতু আপনারা জানেন, আমরা আমাদের ৩১ দফা প্রস্তাবের মধ্যে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব ওখানে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে অধঃস্তন আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের আর্টিকেল ১১৬ আমরা পরিবর্তন বা সংশোধনের সুপারিশ করেছিলাম। যাতে করে বর্তমানে সংবিধানের বিদ্যমান প্রভিশন তাতে বলা আছে যে, প্রেসিডেন্ট করবে প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে। এখানে প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে রাখতে চাই সেটা আমাদের প্রস্তাব। যাতে করে সুপ্রিম কোর্টের আলাদা একটি সেক্রেটারিয়েট হবে সেই প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত। আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে বাজেটে কী হবে না হবে সেটা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে সেটা আমরা মন্তব্যে দিয়েছি।
নি¤œ আদালতের জন্য আলাদা কাউন্সিলের উল্লেখ করে সালাহ উদ্দিন বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনারা জানেন সেটা অলরেডি পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের রায়ে এটা বহাল হয়েছে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে আদলে লোয়ার জুডিশিয়ারির জন্য লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিন প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছি। যাতে একটা জবাবদিহিতা থাকে নি¤œ আদালতের জন্য। এখানে সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লোয়ার জুডিশিয়ারির জবাবদিহিতা কতটুক নিশ্চিত কিভাবে করা যাবে সেটা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সাথেও আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। বিচার বিভাগের যেসব প্রস্তাবনা তারা দিয়ে তার সবগুলোর সাথে আমরা একমত এবং আমাদের নিজস্ব অভিমতও আছে। বিচার বিভাগের ৪/৫ টি বিষয়ে একটু মন্তব্য সহকারে মতামত দিয়েছি।
নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন : সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে দেখা যায় উনারা ২৭টার মতো প্রস্তাব দিয়েছেন। তাতে অধিকাংশ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমরা ঠিক বুঝতে পারেনি যে, নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রিপোর্টে কিছু কিছু বিষয়ে সংবিধানের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নির্বাচনী সংস্কার নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। আমরা সেই বিষয়ে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে মতামত দিয়েছি।
ইসির স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না মন্তব্য করে সালাহ উদ্দিন বলেন, একটি বিষয়ে আমাদের মতামত পজেটিভলি দিয়েছি। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন.. এই ইসির ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য সংস্কার কমিশন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। যেগুলো আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ। যেগুলো আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে থাকা দরকার। যেমন এনআইডি.. এটা যদি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়া হয় তাহলে ইসিকে বার বার এনআইডি বিষয়ে সহযোগিতার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে। তার চাইতে বর্তমানে যে বহাল আছে, অবশ্য একটা আইন আছে যেটা আওয়ামী লীগের আমলে করেছে। এনআইডির কাযর্ক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আইনটি এখনো বাতিল করা হয়নি, বাতিলের জন্য বিবেচনাধীন ছিলো। আমরা মনে করি এই আইনটি বাতিল করে এনআইডির কার্যক্রম পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখা উচিত।
সীমানা নির্ধারণও নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখা উচিত বলে বিএনপি মনে করে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, সীমানা নির্ধারণে ইসির আইন আছে এবং সাংবিধানিক এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশনের সেই আইনে সামান্য একটা প্রিন্টিং মিসটেক ছিলো সেটা আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছিলাম- আইন মন্ত্রণালয় সেটা গিয়েছে কিন্তু এখনো সংশোধন হয়নি। না হওয়ার কারণ ইসি এখনো ডিলিমিটেশন সংক্রান্ত কোনো শুনানি করতে পারছে না। তার ফলে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা সরকারকে আহ্বান জানাব, যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনীটা দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখা হোক। আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে রাখার বিষয়টা আমরা নাকচ করছি।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে বলে কমিশনের একটা সুপারিশ আছে। তাতে আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে যারা আছে এবং ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা তাদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে না রেখে বিদ্যমান যে ব্যবস্থা আছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতাধীন আছে যে একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যে প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয় সেই একই প্রক্রিয়ায়টা নির্বাচন কমিশন এবং দুই-একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেটা সংবিধানের আর্টিক্যাল ৯৬ বলা আছে সেই হিসেবে এবং আরও বড় অথোরিটির কাছে দায়বদ্ধতা আছে সেখানে সংসদীয় কমিটির কাছে নেয়াটা অনেকটা রাজনৈতিক বলে আমরা মনে করি। সেখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা রাখাটা উচিত বলে মনে করছি না আমরা।
সংবিধান সংস্কার কমিশন : সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্প্রেডশীটে উনারা সংবিধানের প্রস্তাবনা উল্লেখ করে নাই। সংবিধানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রস্তাবনা যেটা প্রিয়াম্বল নামে আমরা চিনি সেটা পুরোপুরি সংশোধনের বা পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকটা রিরাইটিংয়ের মতো। সেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে এক কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে যেটা সমচিত বলে আমরা মনে করি না। এটাকে অন্য জায়গায় রাখার বা তফসিল অংশে রাখার বা স্বীকৃতি দেয়ার বিভিন্ন রকমের সুযোগ আছে সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা পরে প্রকাশ করব। কিন্তু সেই প্রিয়াম্বলটা আমরা চাই। যেটা অষ্টাদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থা যেটা পঞ্চম সংশোধনীর পরে গৃহীত হয়েছিলো বাংলাদেশের জনগণের সকল অভিপ্রায় হিসেবে সেইটা বহাল থাকা উচিত।
সালাহ উদ্দিন বলেন, সুপারিশে উনারা শুরু করেছেন রিপাবলিক দিয়ে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন দিয়ে যেটাকে প্রজাতন্ত্র না বলে জনগণতন্ত্র বা নাগরিকতন্ত্র বা পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ এর ক্ষেত্রে বাংলায় বলছেন, জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বাংলায় উনারা নাগরিকতন্ত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ লিখতে চান। সেটা কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। দীর্ঘদিনের প্রেকটিসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাম মেনে নিয়েছে। এখন বিষয়টা নিয়ে যে আসলে কতটুকু কী অর্জন হবে সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে। আমরা এ বিষয়ে একমত নই। তাছাড়া মৌলিক অধিকার এবং মূলনীতির ক্ষেত্রে উনারা ব্যাপক পরিবর্তনের একটা প্রস্তাব ওখানে রেখেছেন। আমরা প্রস্তাব করেছি যে, বর্তমানে সংবিধানিক ধারাগুলো আছে, অনুচ্ছেদগুলো আছে তার মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের প্রস্তাব অনুসারে মূলনীতির মধ্যে যেসব প্রস্তাব আছে তার হয়ত সংশোধনী আনা যায় কিন্তু আমরা দলের পক্ষ থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থায় বহাল রাখার জন্য প্রস্তাব করেছি।
মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা নামে আলাদা চাপ্টার সংযুক্ত করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, যেটা আসলে অনেকটা আমরা মনে করি যে, অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে হয়ত যাদের পার্লামেন্টের এক্সপেরিয়েন্স বা রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে অভিমত আসতে পারে বা দিয়ে থাকতে পারেন। মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিয়তা বিধান করতে হবে.. সেজন্য মৌলিক অধিকারের সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটগুলো সীমিত। এছাড়া সোশ্যাল কালচারাল ইকোনমিক রাইটগুলো সেগুলো রাষ্ট্রের সক্ষমতা ওপরে ভিত্তি করে গুড গভার্নেন্সের ওপরে ছেড়ে দিতে হয়, সেই জায়গায় উনার জিনিসটা একটু মিলিয়ে ফেলেছেন এমালগেমেট করে ফেলেছে..সেটা আমরা আশা করি আলোচনার সময়ে বুঝাতে সক্ষম হব। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ - এখানে উনার যেসমস্ত প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং যেগুলো কমিশনের কথা বলেছেন, বিশেষ করে ন্যাশনাল কন্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠন করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তিদেরকে, এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানদের এখানে মেম্বার করে যেসমস্ত এখতিয়ার, গঠন এবং ধরন কার্যাবলীর প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে করে দেখা যাবে যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে এটা সংবিধানের মূল চেতনা সেই জায়গায় এটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করি।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে উচ্চ কক্ষ এর আসন ও মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সাথেও ভিন্নমত পোষণ করেছেন বলে জানান সালাহ উদ্দিন। মহিলাদের সংসদীয় আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবের সাথে একমত হলেও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সাথে ভিন্নমতের কথাও বলেন তিনি।
সালাহ উদ্দিন বলেন, সংবিধানের প্রায় শতাধিক প্রস্তাবের মধ্যে এখানে স্প্রেডশীটে ৫৭টা এসেছে। সেই জায়গায় বিস্তারিত প্রতিবেদন আমরা যুক্ত করেছি। পুরো পুস্তকটাতে তাদের সুপারিশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আাছে সেগুলো এক জায়গায় এসে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবো। অন্যান্য কয়েকটি কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিবেদন আমরা কয়েকদিন পরে দেবো বলে উনাদেরকে জানিয়েছি।