বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে শুক্রবার লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর আপাতদৃষ্টিতে ‘নির্বাচন কেন্দ্রিক সংকট উত্তরণ’ করা গেছে মনে হলেও সত্যিকার অর্থেই সে সংশয় কতটা দূর হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের কারও কারও ধারণা, প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক জটিলতা এখনো কাটেনি, বরং সামনের সময়টায় ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও জটিল’ হয়ে উঠতে পারে। বৈঠকের পর কেবলমাত্র নির্বাচন কেন্দ্রিক সম্ভাব্য সময়সীমার বিষয়ে আলোকপাত করেছে সরকার এবং বিএনপি। তবে, বৈঠকের সম্ভাব্য ফলাফল, রাজনীতিতে এর তাৎপর্য এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া, এমন নানা বিষয় নিয়ে এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে আলােচনা চলছে। বৈঠক নিয়ে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বর্তমান সময়ে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল জামায়াতে ইসলামী অভিযোগ করেছে, বিএনপির সাথে আলোচনা করে সরকার যেভাবে ব্রিফিং ও বিবৃতি দিয়ে বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছে তাতে একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করেছে। দলটি একইসাথে বলছে, লন্ডনের ঘটনায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। একইভাবে মন্তব্য করেছে এনসিপিও। তারাও বলেছে, বৈঠকে যেভাবে নির্বাচন ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে, সেভাবে সংষ্কার বা বিচার নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে কিছু রাজনীতিক দল লন্ডনের বৈঠকটিকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন। তারা মনে করছেন, আপাতত পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, আল্টিমেটামের রাজনীতির অবসান হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতিতে যে অবিশ্বাস, সন্দেহ-সংশয় ছিল, সেটি আপাতত দূর হয়েছে।

সূত্র মতে, লন্ডনের বৈঠককে জামায়াতে ইসলামী ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। তারা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড, ইউনূস যে কোনো রাজনীতিক দলের সাথে বৈঠক করতে পারেন। কিন্তু সরকার প্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী। গতকাল শনিবার দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেখানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু একটি দলের সঙ্গে আলাপ করে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। আমরা আশা করি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবেন।

শুক্রবার লন্ডনে বৈঠকের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এই বিষয়টিকে পজিটিভ মনে করি। তবে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এ-ও বলেছেন-সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি? অর্জন করা প্রয়োজন হবে। এই একটি কথার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন আগেও করা যেতে পারে, পিছিয়েও যেতে পারে। এখানে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে-এটা তো বলা যাবে না।

বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, রমযানের আগে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসাবে দেখছি। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গুমোট পরিবেশ ছিল তা অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমযান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সরকার যদি সংস্কার অর্থ করিডর দেওয়া, বন্দর লিজ দেওয়া, এগুলোকে বোঝান-যা তাদের প্রেস সচিব বলেছিলেন এসব বিষয় নাকি সংস্কার করার ম্যান্ডেট তাদের আছে। এ বিষয়ে তো আমরা দৃঢ়ভাবে দ্বিমত করি। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন নেই। আমরা মনে করি গণ-অভ্যুত্থানের সময় যেসব হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কাজ দৃশ্যমান করা এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, এই বৈঠকের ফলে নির্বাচনের পাশাপাশি সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির কাজটি এখন যথাযথ মনোযোগ পাবে বলে আমরা আশা করি।

এদিকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি জানায়, আমরা নিঃসন্দেহে এই আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানাই। তবে সেই সঙ্গে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।

নতুন দল এনসিপি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। তারা আশা করছেন, বিএনপি এখন এই দুই ইস্যুতে সহযোগিতা করবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যে দুশ্চিন্তা মানুষের মধ্যে ছিলো, তা অনেকটা কেটে গেছে এবং এর ফলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, তারেক রহমান ও ড. ইউনূস বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা এবং এর ফলে বিএনপির আর রাস্তায় আন্দোলনে নামার সুযোগ থাকলো না। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্ব তারেক রহমানের হাতে, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে সরকার নিশ্চয়তা পেয়েছে বিএনপি রাস্তায় নামছে না।

আরেক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, দ্রুত নির্বাচনই বিএনপির জন্য বড় বিষয় এবং সে কারণেই তারা হয়তো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছাড় দিয়েছে। একটা সমঝোতার জায়গা তৈরি হয়েছে। কিছু ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছিলো। হয়তো দুপক্ষই কিছু জায়গায় ছাড় দিয়েছে। ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় প্রভাব হলো- আগামী মাসগুলোতে নির্বাচনের কাক্সিক্ষত রোডম্যাপ পেয়ে গেলে বিএনপি নীরব থাকবে এবং সরকারকেও কোনো সংকটে পড়তে হবে না।

সূত্র মতে, বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য শক্ত অবস্থান প্রকাশ করে আসছিলো। শুক্রবারের বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়েছে, সেখানেও শুধু নির্বাচন প্রসঙ্গই গুরুত্ব পেয়েছে। তবে এতে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের রমযানের আগেই বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্য ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে শুধু নির্বাচন নয়, বরং নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে সেখানে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদও বলছেন, নির্বাচন ও ভবিষ্যতমুখী অর্থাৎ নির্বাচন পরবর্তী বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে। যদিও তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এই বৈঠকে নির্বাচন পরবর্তী বিষয়গুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছে মধ্যস্থতাকারীরা, যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পরবর্তী সংসদে সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা। যদিও এ বিষয়ে সমঝোতা কতটা হয়েছে তা এখনো অনিশ্চিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টোটাল রাজনীতির দোলাচল। সরকারের ভূমিকা নিয়ে উৎকণ্ঠা কিংবা যে প্রশ্ন উঠছিলো, তার কিছুটা সমাধান হলো। এখন সরকারের উচিত আলোচনার বিষয়বস্তু জনগণের কাছে প্রকাশ করা এবং সবাইকে আস্থায় নিয়ে বিচার সংস্কার ও নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তারা বলছেন, এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো জুলাই চার্টারের জন্য সব দলকে এক জায়গায় আনা, বিচার কাজ এগিয়ে নেয়া এবং সত্যিকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।

রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন বিষয়গুলোতে সংস্কার হবে সে বিষয়ে সব দলকে এক করা, আন্দোলনের সময় হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করার পাশাপাশি পক্ষপাতহীন নির্বাচনের পরিবেশ ও একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সরকার যে তৈরি করতে পারবে, এই আস্থা তৈরি করাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সরকার যদি সেটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপেক্ষিতই থেকে যাবে।