সংখ্যানুপাতিক ভোটের দাবি দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদ, ফ্যাসিবাদ ও চরমপন্থার বিকাশের পথ সুগম করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারেক রহমান। গতকাল সোমবার বিকালে পেশাজীবীদের এক আলোচনা সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, কয়েকটা রাজনৈতিক দল হঠাৎ করেই দেশে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন দাবি করছেন বা দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের অর্থ কিন্তু রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ, ফ্যাসিবাদ, চরমপন্থার বিকাশের পথ সুগম করে দেওয়া।

তারেক রহমান বলেন, সংখ্যানুপাতিক যে নির্বাচনী ব্যবস্থা এটা কিন্তু বিভ্রান্তিমূলক, সমাজ সৃষ্টি এবং সরকার অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে উঠতে পারে বা উঠবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। দেশের জনগণের সুদৃঢ় ঐক্য চাইলে কোনভাবেই আমরা মনে করি না, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত নয়।

তারেক রহমান বলেন, এই ধরনের (পিআর সিস্টেম) দাবি উত্থাপনের বিষয়টিকে কোন কোন দল গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে দেখলেও, বিবেচনা করলেও দেশ এবং জনগণের সাথে বিএনপি বাংলাদেশকে সংখ্যানুপাতিক যে পিআর সিস্টেম বা এই নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য উপযোগী নয় বলেই আমরা মনে করি। কারণ আমরা যদি একটু দেখি ভালো করে, ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে আরো একবার কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে. এই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এই গণঅভ্যুত্থান নিজেই কিন্তু একটি বিষয় প্রমাণ করে। সেটা হলো যে, দেশকে যদি দাবিদার মুক্ত রাখতে হয়, ফ্যাসিবাদ মুক্ত রাখতে হয় তাহলে জনগণের ঐক্যই হচ্ছে সবচাইতে বেশি জরুরি।

রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন চত্বরে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের উদ্যোগে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৬ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পেশাজীবীদের অবদান’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচনার শুরুতে উত্তরার দিয়াবাড়িতে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ দুর্ঘটনা এবং ফ্যাসিস্ট আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়।

ফ্যাসিস্ট আন্দোলনে পেশাজীবীদের ভূমিকার ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয় অনুষ্ঠানে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনসহ জুলাই অভ্যুত্থানের পেশাজীবীদের ওপর একটি স্মরণিকাও প্রকাশ করে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ যার মোড়কও উন্মোচন করা হয় অনুষ্ঠানে। পরে আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার নিহতদের পরিবারের সদস্যদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব।

তারেক রহমান বলেন, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সংস্কৃতি সবদিক থেকে সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশ সংবিধি বিধি-বিধান আর আইন-কানুন দিয়ে ফ্যাসিবাদকে অথবা স্বৈরাচারকে কিন্তু রোধ করা যায় না। আইন-কানুন না মানার কারণেই কিন্তু কেউ কেউ ফ্যাসিস্ট কিংবা অটোক্রেট হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র-রাজনীতি-ফ্যাসিবাদ যদি ঠেকাতে হয় আমরা যদি ঠেকাতে চাই বা ঠেকাতে চাইলে জনগণকে যেকোন মূল্যে রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রে জনগণের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের চর্চা এবং প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ যদি ক্ষমতাবান থাকে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ জারি থাকে ফ্যাসিবাদ কিংবা স্বৈরাচার ঠেকানোর জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি যথেষ্ট। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ইচ্ছা এবং শক্তি কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই বিএনপি বারবার জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি সেই প্রথম থেকে জানিয়ে আসছে।

একটি অংশ জাতীয় নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করছে মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খেয়াল করলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আমরা দেখছি, বিভিন্ন পেশার মানুষ কথা বলছে একটি বিষয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘাড়ে যারা বন্দুক রেখে সরকারের উপর নিজেদের খবরদারীর বহাল রাখতে চায় সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে, বিভিন্ন ফায়দা হাসিল করতে চায় বা নিজেদের আখের গোছাতে চায় তাদেরকেই আমরা দেখছি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেকে সুকৌশলে বাধা সৃষ্টি করছে। এটি এখন আস্তে আস্তে বিভিন্ন জায়গা থেকে সামনে আসছে কথাটা। গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কিন্তু কোন এককগোষ্ঠী বা দলের নয়। এই কথাটি প্রথম থেকে আমি এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আমরা সকলে বলে আসছি, সকল শ্রেণী পেশার মানুষ একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছে, অধিকাহারা মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। নিত্য নতুন রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ কিংবা রাজনৈতিক মেরুকরণের আড়ালে আমরা গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদ প্রাণের আত্মত্যাগের কথা যেন ভুলে না যাই। প্রতিদিন বিভিন্নভাবে নিত্য নতুন দাবি আসছে। কিন্তু শহীদদের যে আত্মত্যাগ এই বিষয়টিকে যাতে এসবের ডামাডোলে যাতে আমরা ভুলে না যাই।

শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করবেন না মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে রাষ্ট্র এবং সরকারে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য নানা রকমের অপকৌশল করছেন তাদের প্রতি আমার দলীয় অবস্থান থেকে আমার দলের পক্ষ থেকে বিনীত আহ্বান করবো, দয়া করে শহীদদের রক্তের সঙ্গে আপনারা বেইমানী করবেন না। শাসক পাল্টেছে কিন্তু শাসনের চরিত্র বোধহয় পাল্টেনি। জনগণের এমন একটা ধারণা যদি সৃষ্টি হয় তা হবে কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিশাল বড় সংকেত, সংকট হবে সেটা। যদি জনগণের মধ্যে এরকম কোন ধারণা হয়।

শহীদদের নামে সকল প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হবে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, নিজের জীবন দিয়ে যেসব বীর সন্তানেরা দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছেন, এবার সেইসব শহীদদের প্রতি আমাদের ঋণ পরিষদের পালা। জনগণের রায় বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ শহীদদের নামে করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে প্রশিক্ষন বিমান দূর্ঘটনার কারণে তারেক রহমানের অনুরোধে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয় এবং আহতদের রক্তের জন্য দলের নেতা-কর্মীদের দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার নির্দেশনাও দেন তারেক রহমান।

ঘটনার পরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে দূর্ঘটনায় আহতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য চিকিৎসকসহ পেশাজীবীদের কাজের তদারকি করেন।

সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব কাদের গণি চৌধুরী, অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, কায়সার কামালের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সায়মা ফেরদৌস, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মরহুম রুহুল আমিন গাজীর ছেলে আফফান আবরার আমিন, শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মেহেদি হাসানের বাবা মোশাররফ হোসেন, সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ, শাহরিয়ার সুলতানের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা, মুত্তাকিম বিল্লাহর স্ত্রী নাঈমা বিল্লাহ মিতু, সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম, সাফওয়ান আখতারের বাবা আখতারুজ্জামান, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা-এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল প্রয়াত আবদুল রহীমের ছেলে আবরার রহীম এবং পিলখানার হত্যাকান্ডের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বিডিআরের সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল কামরুজ্জামান বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর বড় ভাই অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী নাসরিন হক, অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমেদের মেয়ে অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন, সাংবাদিক এবিএম মূসার ছেলে ডা. নাসিম মূসা পরশ, গিয়াস কামাল চৌধুরীর ছেলে রফিক-উম মুনির চৌধুরী প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।