গণভোট ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এটি সংসদ নির্বাচনের দিন নাকি তার আগে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ‘ হ্যা ও না’ এর প্রচারণা। এটিকে কেন্দ্র করে সংশয়ে পড়তে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও। গণভোট কবে হবে- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হলে নতুন সংকট তৈরির শঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে এক দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে ভিন্নমত পোষণ করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদদের। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই দিন গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন আয়োজন হলে তা জনগণের মাঝে ধোঁয়াশা তৈরি করতে পারে। গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমতের প্রস্তাবগুলো সমন্বয় না হলে গণভোট গৌণ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে সরকারের ব্যয় সংকোচন করতে জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের পক্ষে মত অনেক রাজনীতিবিদের।

সূত্র মতে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের লক্ষ্যে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যেখানে দীর্ঘ আট মাসের যাত্রায় দুই পর্বের আলোচনায় উঠে আসে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব। এর মধ্যে ১৪টি প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি আনে দলগুলো। গণভোটের সময়, ধরণসহ তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য ছাড়াই শেষ হয় কমিশনের আলোচনা। এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র সংস্কার সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে বহুল আলোচিত জুলাই সনদ স্বাক্ষরের তারিখ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক এ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সুপারিশ তুলে দেন। সেখানে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে।

বিএনপিসহ কিছু দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে আলাদা ব্যালটে গণভোট করার পক্ষে মত দিয়েছিল। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার পক্ষে মত দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও তাদের সুপারিশে গণভোটের সময়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি। গণভোটের সময়ের বিষয়ে খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা ওই নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট করা হবে।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। কমিশন বলেছে, সরকার এই আদেশ জারির পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যেকোনো সময়ে এইটা করতে পারবে। এই কাজটা আসলে নির্বাচন কমিশনের। এ জন্য আদেশের মধ্যে গণভোটের বিষয়ে একটা অধ্যাদেশ লাগবে। সেটা সরকার করবে, এটা আদেশেরই অংশ। ফলে আমরা কোনো দিনক্ষণ বেঁধে দিচ্ছি না।

জানা গেছে, গণভোটে মূলত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এবং আদেশের তফসিলে থাকা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন নেওয়া হবে। এটি হবে মূলত একটি প্যাকেজ এবং একটি প্রশ্ন। গণভোটের প্রশ্ন হবে এ রকম ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন? আলী রীয়াজ বলেন, গণভোটে সাধারণত একটি বা দুটো প্রশ্ন হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে বেশি হয়েছে। দুয়েকটি দেশে দেখা গেছে পাঁচটা বা ছয়টা প্রশ্ন। কিন্তু এযাবৎকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশ্ন একটা ছিল। তুরস্কের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেখানে ২১টি বিষয় ছিল এবং সেটি অত্যন্ত সামান্য ব্যবধানে জিতেছিল। ওই ২১টি বিষয়ের মধ্যে কেউ কেউ একটি, উনিশটি বা বিশটি বিষয়ে একমত হলেও ভোট দিয়েছেন। পৃথিবীতে বাংলাদেশই প্রথম গণভোট করবে না, যেখানে একটি মাত্র প্রশ্ন দিয়ে অনেকগুলো বিষয়কে ধারণ করার চেষ্টা হচ্ছে। জানা গেছে, অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে গণভোটের ব্যালট বড় হতে পারে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণভোটের বিষয়বস্তু ভোটাররা ভালোভাবে অবহিত না হলে এবং ভোট দেয়ার পদ্ধতি সহজ না হলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের কমিশনের সুপারিশগুলোকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং দলগুলোর সঙ্গে শেষবারের মতো আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ৪৮টি বিষয়ের প্যাকেজ থাকবে। ওটার বিপরীতে হ্যাঁ অথবা না উত্তর। একই সঙ্গে এই ৪৮টির ভিত্তিতে একটা সংবিধান সংশোধন বিলের খসড়াও ব্যালেটে থাকবে। জনগণ হ্যাঁ অথবা না উত্তর দেবে। আমরা বলেছি সরকার সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচনের দিনে না হয় নির্বাচনের আগে যে কোনো সময়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাব্বির আহমেদ বলেন, ইনস্টিটিউশনাল এক্সপার্ট দিয়ে আবার রাজিনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসা উচিত। সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করা। যেগুলো সংকট তৈরি করতে পারে, ক্রাইসিস তৈরি করতে পারে সেগুলোকে বাদ দেয়া। কমিশন যেভাবে বলছে সেটাকে চূড়ান্ত হিসেবে না দেখা।

সূত্র মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ইস্যুতে বেশ কিছুদিন ধরে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে চলছে নানা আলোচনা। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবিতে অনড়। এমন পরিস্থিতিতে গণভোট ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে চলছে ‘হ্যাঁ-না’ পোস্টের প্রতিযোগিতা। ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ লেখা পোস্টে ভরে গেছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের নিউজফিড। যারা জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চান তারা ‘হ্যাঁ’ লেখা পোস্টার শেয়ার করছেন। আর যারা জাতীয় নির্বাচনের দিন বা তার পরে গণভোট চান তারা ‘না’ লেখা পোস্টার শেয়ার করছেন। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ নেটিজেনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে প্রথমে ‘না’ ক্যাম্পেইন শুরু হয়। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে পাল্টা ‘হ্যাঁ’ ক্যাম্পেইন শুরু হয়। মুহূর্তে এই ‘হ্যাঁ-না’ ক্যাম্পেইন ভাইরাল হয়ে যায়। বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রদলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে ‘না’ লেখা ফটোকার্ড শেয়ার করা হয়। একই ফটোকার্ড পোস্ট করেন ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরও। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ‘হ্যাঁ’ লিখে পোস্ট করা হয়। এরপর ভোরের দিকে ছাত্রদলের ভেরিফায়েড পেজে আরেকটি ফটোকার্ড শেয়ার করা হয়, সেখানে চারটি পয়েন্টে লেখা রয়েছে, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্রকে ‘না’ স্বাক্ষরের পর জুলাই সনদ পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রকে ‘না’; জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটকে ‘না’ এবং শত শহীদের রক্তে কেনা জুলাই কারও বাপের ‘না’।

গণভোট নিয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, এসব বিষয়ে শিগগির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। ২৭০ দিন আলাপ আলোচনার করার পর রাজনৈতিকদলগুলোর বক্তব্যে যে অনৈক্যের সুর দেখছি, এটা হতাশাজনক। আগে বিষয়বস্তু নিয়ে বিরোধ ছিল। এখন গণভোট নিয়ে দ্বিমত তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দলগুলোও উত্তেজিত ভূমিকা পালন করছে। মতানৈক্য থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, বিরোধ এত দৃঢ় এবং পরস্পরবিরোধী, কী বলব? যে উত্তেজিত ভূমিকা নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো, যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে ছিল, আপনারা যদি এরকম একটা ভূমিকা নেন, তাহলে সরকার কী করবে? আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না।

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মু. তাহের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াত গণভোট চায়। জামায়াতের বক্তব্য পরিষ্কার- জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান, নবেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোটের ব্যবস্থা গ্রহণ, জোটের প্রার্থী হলেও নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা, ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, আমরা যখন সংস্কারের জন্য গণভোটের কথা উল্লেখ করেছি, তখন বিএনপি মেনে নিয়েছিল। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চেয়েছি। বিএনপি বলছে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সাথে একই দিনে হবে। সংস্কার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকলেও বিএনপি হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন করেছে। আরপিও, সংস্কার, গণভোট কোনোকিছুই এখন বিএনপি মানছে না। তিনি বলেন, যদি নির্বাচন না হয় তাহলে যারা পালিয়ে গিয়ে ভারতে বসে ষড়যন্ত্র করছে, তারা একটা সুযোগ নেবে। সংস্কারবিহীন যে বাংলাদেশ ছিল বিএনপি সে জায়গায় ফিরে যেতে চায়। বাংলাদেশকে আওয়ামী জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে যেতে এ দেশের মানুষ দিবে না। সরকার যদি তার নিরপেক্ষতা হারায়, তাহলে দেশের জনগণ সরকারের প্রতি আস্থা হারাবে। জনগণ আবার আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে। তিনি আরো বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষতা হারায় এবং কোনো দলের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে তাহলে এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এটা নিয়ে সংশয়া তৈরি হবে।

সূত্র মতে, ‎দেশে এ পর্যন্ত গণভোট হয়েছে তিনবার। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট। এখন চতুর্থ দফা নিয়ে চলছে আলোচনা। আগের তিনবার সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়ে গণভোট হলেও এবার সংবিধান সংশ্লিষ্ট প্রায় অর্ধশত বিষয়ে হবে হ্যাঁ-না ভোট। এর বিপরীতে মতামত দেবেন নাগরিকরা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত যাচাই করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই গণভোট। ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল গণভোটের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। ফলাফলে দেখা যায়, ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়ে। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ‘না’ ভোট ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ছিল এই গণভোট। আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে ‘না’ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ভোটার অংশগ্রহণের হার ছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরপর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে বিল পাস হয়। সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনীর ওই বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না, তা নির্ধারণে ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোটার ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ভোটার ‘না’ ভোট দেন। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে গণভোটের বিষয়টি সামনে আসে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনের আগে গণভোটের সুযোগ এখন আর নেই। নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে। দুটি ব্যালট থাকবে, একটি গণভোটের জন্য, আরেকটি জাতীয় সংসদের জন্য। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তিনি বলেন, আজ সেই নির্বাচন বানচালের জন্য একটি মহল উঠে-পড়ে লেগেছে, তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

একই দিন গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন আয়োজন হলে তা জনগণের মাঝে ধোঁয়াশা তৈরি করতে পারে বলে মত দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমতের প্রস্তাবগুলো সমন্বয় না হলে গণভোট গৌণ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণভোটই ঐকমত্যে পৌঁছানোর একমাত্র মঞ্চ। তবে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে সমন্বয় করা হলে তা জনগণের মাঝে ধোঁয়াশা তৈরি করবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, গণভোট একই দিনে কেন হতে হবে? এক দিনে হওয়ার কারণটা কী? মানে খরচ বাঁচানোর জন্য। বাংলাদেশের কত টাকা কত দিকে খরচ হচ্ছে তার কোনো হিসাব নাই। গণভোট হলো ডিরেক্ট ডেমোক্রেসি, মানে সরাসরি জনগণ বলছে আমি এটা চাই আর এটা চাই না। এটার ওপরে আর কোনো কথা হতে পারে না। যখন গণভোটে একটা জিনিস পাস হয়ে যায়, সেটাকে সংযোজন, বিয়োজন করার অধিকার সংসদের নাই।

বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ এডভোকেট শিশির মনির বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হলে গণভোট অত্যাবশ্যক। তিনি এ-ও মনে করেন, অতীতে আদেশ জারির ২১ দিনের মধ্যেই গণভোট হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না, যা নির্বাচনকে ‘সংশয় বা অনিশ্চয়তার’ মধ্যে ফেলে দেয়।