আমাদের জাতির ইহিতাস বিকৃত করা হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭১ সহ বাংলাদেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের কোন দলিল বাংলাদেশে কেন নেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, কারণ এক ব্যক্তির মিথ্যাচারকে টিকিয়ে রাখতে প্রকৃত শহীদদের কোন দলিলপত্র করা হয়নি। জুলাইয়ের ইতিহাস যাতে কখনো কেউ বিকৃত করতে না পারে কিংবা মুছে দিতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সর্বপ্রথম জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক প্রকাশ করেছে।
বুধবার (০৫ ফেব্রুয়ারী) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে 'জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক' মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের বীরত্ব তুলে ধরতে ভূমিকা রাখবে জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক। এসময় তিনি জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক পৃথিবীর সকল ভাষায় পর্যায়ক্রমে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করার ঘোষনা দেন। ১০ খন্ডে প্রকাশিত এই শহীদ স্মারকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে যারা আত্মদান করেছেন সকল বীর শহীদদের তথ্য সংরক্ষণ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ৫ আগস্ট তথা ৩৬ জুলাইকে জাতীয় ছুটির তালিকায় অন্তভূক্ত করার দাবিও জানান আমীরে জামায়াত। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৩৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। এই দিন হাজার-হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবকের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদ ছিলো স্বাধীন দেশে ভিনদেশী সরকারের আওয়ামী পুতুল সরকার।
ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ গঠনে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশিত বৈষম্যহীন, সাম্য, মানবিক ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণ বাংলাদেশ গঠনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আমীরে জামায়াত বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে সুখী-সমৃদ্ধ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার। ঐ বাংলাদেশ গঠনে জামায়াতে ইসলামী সকল রাজনৈতিক দলমত ও দেশপ্রেমিক নাগরিকেদের এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করছে। যেই ঐক্যে আমাদের জুলাই বিপ্লব হয়েছে, সেই ঐক্য বজায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারী ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারী ড. রেজাউল করিমের যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ২য় স্বাধীনতা জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস যাতে কখনো কেউ মুছে দিতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শহীদদের স্মারণিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়ে এই স্মারক প্রকাশ করছে। জাতীয় প্রেস ক্লাব ছাড়াও নারায়নগঞ্জ, চট্রগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট প্রেস ক্লাবে একযোগে ‘জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক’- মোড়ক উম্মোচন করা হচ্ছে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল সাবেক এমপি এইচ. এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জামায়াতে ইসলামী এদেশে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে সকল নাগরিকের আশা-আকাঙ্খা পূরণে কাজ করছে। জামায়াতে ইসলামী ইতিহাস রচনা করে, ইতিহাস মুছে দিতে দেয় না, দিবে না।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক বলেন, জামায়াতে ইসলামী জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক প্রকাশের মাধ্যমে এক মহান দায়িত্ব ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি রাষ্ট্র করার কথা থাকলেও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের সেদিকে মনোযোগ দেখা যায়নি। এসময় তিনি আরো বলেন, নতুন বাংলাদেশে আর কোন অপশক্তি যাতে জনগণের উপর জুলুম নির্যাতন করতে না পারে সেই লক্ষ্যে জনগণের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গঠনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঐক্যের বিকল্প নাই। অচিরেই ইসলামের ঐক্যের মাধ্যমে এদেশে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়াই জামায়াতে ইসলামী বরাবরই রাষ্ট্রের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করছে। জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক প্রকাশ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল কিন্তু রাষ্ট্র সেটি করতে পারেনি। সেটি করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সক্ষমতা রাখে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
১২ দলীয় ঐক্য জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, জুলাই বিপ্লবের শহীদ স্মারক প্রকাশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী ইতিহাসের পাতায় এক প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, এই সংগঠনের উপর অনেক জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখা যায়নি। তিনি ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ গঠনে যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল আন্দোলন সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এক ছিল আগামীতেও এক ও ভিন্নভাবে দেশের স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, জামায়াতে ইসলামী এদেশের জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সকল আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। আগামীতেও ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৬ মাসে একটি গণহত্যারও বিচার করতে পারেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার এই দায়িত্ব জামায়াতে ইসলামীর হাতে দেওয়া হলে, সকল গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হতো বলে আমরা বিশ্বাস করি। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আগামী দিনের যে কোন আন্দোলন সংগ্রামে তার দল থাকবে বলেও তিনি প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর একুশে পদক প্রাপ্ত ডক্টর সুকোমল বড়ুয়া বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিগত সময় নানামূখী অপপ্রচার চালানো হয়েছে। বাস্তবে জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম দেখে বুঝতে পারছি এই সংগঠনে দক্ষ ও সৎ নেতৃত্ব রয়েছে। এদের হাতে বাংলাদেশ নিরাপদ বলে আমি বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব এডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রমাণিক বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিদের্শে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকে হাসিনা সরকার হত্যা করেছে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচার হওয়া দরকার। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়নি হতেও দেওয়া হবে না। এখানকার সকল ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করছে। অতিতে বলা হতো জামায়াতে ইসলামী ধর্ম পালনে বাধা দিবে কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর দেখা গেছে জামায়াতে ইসলামী এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিয়েছে। তাই বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীর হাতে সব ধর্মের মানুষ নিরাপদ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, জামায়াতে ইসলামী এদেশের কোন অর্জন, কোন ইতিহাস বিকৃত হতে দিবে না। সকল ইতিহাস সংরক্ষণ করা হবে। জামায়াতে ইসলামী এদেশের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এবং করবে।
কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, জামায়াতে ইসলামীর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ এটার প্রমান জামায়াতে ইসলামী তাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বারবার দিয়ে আসছে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী জামায়াতে ইসলামী ব্যতিত আর কোন দল বা সংগঠন শহীদদের তালিকা করে খুঁজে খুঁজে তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম শহীদ স্মারক প্রকাশিত হয়েছে এটি সত্যি প্রশংসনীয়। অথচ এটি করার কথা ছিলো রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র সেদিকে মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে না। আমরা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে বদর যুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করে প্রেরণা যোগাতে সক্ষম হয়েছি। বহু সংগ্রামী সৈনিক না খেয়ে দিন-রাত কেটেছে, না ঘুমিয়ে রাতারাতি সংগ্রাম করেছে। এই বিপ্লবের চেতনা রক্ষায় গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে তিনি উপদেষ্টা পরিষদকে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সাদিক কায়েম বলেন, জামায়াতে ইসলামী শহীদ ও আহতদের চিকিৎসার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্র তা নিতে পারেনি। ৬ মাসেও রাষ্ট্র শহীদের নিয়ে কোন উল্লেখযোগ্য কাজ করেনি।
উপস্থিত শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাদের বক্ত্যব্যে সকলেই এক বাক্যে গণহত্যার বিচার শেষ না করে এদেশে কোন নির্বাচন চান না জানিয়ে বলেন, গণহত্যার বিচারের দাবি এড়িয়ে গিয়ে কেউ কেউ নির্বাচনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাদেরকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, ক্ষমতার লিপ্স ছেড়ে দেশপ্রেম লালন করুন। দেশ ও জাতির জন্য রাজনীতি করতে শিখুন। নতুন বাংলাদেশ গঠনের আগে নতুন বাংলাদেশ স্বাধীন যারা করেছে তাদের পরিবারের কথা শুনুন। যেভাবে জামায়াতে ইসলামী শহীদ পরিবার গুলোর মনের কথা ও বেদনা বুঝতে পেরেছে। শহীদ পরিবারগুলো নির্বাচনের আগে গণহত্যার বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সহ সংশ্লিষ্টদের শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী না করার অনুরোধ করেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান উপস্থিত জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শহীদ পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর যাবতীয় কার্যক্রম এক আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য। জামায়াতে ইসলামী ভোটের জন্য জনগণের সাথে তামাশা আর নাটক করে না। জনগণই সিদ্ধান্ত নিবে আগামীতে কাকে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব দিবে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন,দৈনিক সংগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাজ্জাদ রহমান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারী মাহফুজুর রহমান,ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, ইয়াসিন আরাফাত, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারী মো: দেলাওয়ার হোসেন, কামাল হোসাইন সহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।