ফেনী থেকে একেএম আবদুর রহীম : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ সফিকুর রহমান বলেছেন, ফেনী অঞ্চলে বিগত ভয়াবহ বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হতে বহু বছর লেগে যাবে। ভারত বাংলাদেশের অভিন্ন নদী মুহুরী নদীর বাঁধ কেটে দিয়ে ভাটি অঞ্চলের এই জেলাকে ভয়ানক সংকটে ফেলে দিয়েছিল। আমরা বন্যার মূল সমস্যার স্থলে এসে দেখলাম এটা নো মেন্স ল্যান্ড। এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি অবিলম্বে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বসে এর একটি স্থায়ী সমাধান করবেন। শান্তিপূর্ণভাবে আশু সমাধান কামনা করছি।
জামায়াত আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের অংশের বেড়ি বাঁধের যে অবস্থা দেখলাম তাতে বুঝা যায় এটা খুব দুর্বলভাবে তৈরি হয়েছে। যেন তৈরিই হয়েছে ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য। এখানে বড় রকমের দুর্নীতি হয়েছে। ফলে বারবার মানুষ দুর্ভোগে পড়ছে। দুর্নীতিপরায়ন লোকেরা মানুষের নিরাপত্তার কথা ভাবেনি। তিনি বলেন, আমরা চাই ভবিষ্যতে এমন সরকার আসুক যাদের সততা থাকবে, স্বচ্ছতা থাকবে, দায়বদ্ধতা থাকবে। যারা জনগণের আমানত খেয়ানত করবে না।
তিনি গতকাল সোমবার সকালে এক সফরে ফেনী এসে পৌঁছেন। সারকিট হাউজে নাস্তা সেরে তিনি রওয়ানা দেন জেলার পরশুরাম উপজেলার নিজ কালিকাপুর গ্রামের মুহুরী নদীর বল্লামুখা বাঁধ পরিদর্শন করতে। এই বল্লামুখা বাঁধ বিগত ভয়াবহ বন্যার সময় বিএসএফ কেটে দিলে ফেনীতে দেখা দেয় শত বছরের ভয়াবহ বন্যা। সে সময় এক বুক পানিতে হেঁটে হেঁটে তিনি ত্রাণ বিতরণ করে মানুষকে ভরসা দিয়েছিলেন এবং বলে গিয়েছিলেন যে খুব শীঘ্রই তিনি আবার তাদের দেখতে ফেনী আসবেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও কুমিল্লা জেলা আমীর মাওলানা কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রব,জামায়াতের কুমিল্লা অঞ্চলের টীম সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভূঁইয়া,সাবেক জেলা আমীর একেএম শামছুদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য মাওলানা আলাউদ্দিন, ফেনী জেলা আমীর মাওলানা আবদুল হান্নান, জেলা সেক্রেটারি মাওলানা আবদুর রহিম,ঢাকা মহানগরী উত্তর সহকারী সেক্রেটারি ডাঃ ফখরুদ্দিন মানিক,ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ সহকারী সেক্রেটারি এড.কামাল উদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণ কর্মপরিষদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন সাঈদ।
জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান বল্লামুখা বেড়ীবাঁধ পরিদর্শনে যাওয়ার পথে ফেনী শহরের সুলতানপুরে একজন হত দরিদ্র হিন্দু পরিবারকে একটি নতুন ঘর নির্মাণ করে তার হাতে তুলে দেন,পরে ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুরে ফেনীর মহিপালের শহীদ ইসতিয়াক আহমদ শ্রাবনের কবর যেয়ারত করেন এবং সেখানকার কালিরহাট বাজারে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। পরে বল্লামূখা থেকে ফেরার পথে পরশুরাম বাজারে এক পথ সভায় এবং দাগনভূঞা উপজেলার আতাতুর্ক সরকারী হাইস্কুল মাঠে এক পথ সভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি বাদ জোহর ফেনীর ১৩ জন শহীদের পরিবার ও সাড়ে তিনশত আহতদের সাথে মত বিনিময় করেন এবং তাদের হাতেনগদ সহায়তা উপহার স্বরূপ তুলে দেন। আমীরে জামায়াত পথ সভা গুলোতে বলেন, রাজনীতিতে বলা হয় ব্যক্তির চেয়ে দল বড় দলের চেয়ে দেশ বড়। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে রাজনীতিবিদরা এই স্লোগান প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমান প্রজন্ম আর এই ব্যর্থতা দেখতে প্রস্তুত নয়। তারা চায় রাজনীতিবিদদের সফল হতেই হবে। ’২৪ এর চেতনার বিপক্ষে যেন আমরা না দাঁড়াই। আমাদেরকে জনগণের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে।
তিনি বলেন ,জাতি ধর্ম দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশ আমাদের সবার। আমরা চাই দেশ শান্তিতে থাকবে। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হবে। প্রতিটি নাগরিক মর্যাদাবান নাগরিক হিসাবে পরিচয় দিয়ে স্বস্তি বোধ করবে। দেশে-প্রবাসে যারাই আছেন তারা যেন একজন গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে যেন নিজের পরিচয় সানন্দে প্রকাশ করতে পারেন জামায়াতে ইসলামী তেমন একটি মানবিক সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখে। যে সমাজে সীমাহীন বৈষম্য থাকবে না এবং মানুষের অধিকারের প্রতি কেউ হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস দেখাবে না।
অতীতে আমরা এমন এক বিচিত্র সংসদ এবং সরকার পেয়েছিলাম যে সংসদ ও সরকার জনগণের জন্য ছিল না। সেখানে ব্যক্তি বন্দনায় নেচে গেয়ে জনগণের টাকা নষ্ট করা হতো। এক ব্যক্তির ইশারায় সবাই উঠতো বসতো।
ইতিহাস এমন ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক যারা ছিল তারা বলতো আমি হচ্ছি বড় রব। তারা আল্লাহকে ভয় করে না তারা ক্ষমতা যাওয়ার আগে মানুষের পায়ে ধরে ,হাত জোর করে ক্ষমা চায় ,কান্নাকাটি করে ,আর যখন ক্ষমতায় যায় দেশের আপামর মানুষকে কাঁদাবার ব্যবস্থা করে। গত ১৫ বছর জাতি বেদনার সাথে সেটাই লক্ষ্য করেছে।
যারা দেশ পরিচালনা করবে তারা হবে নিরেট জনগণের খাদেম। যেদিন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তারা গ্রহণ করবেন তার আগেরদিন পর্যন্ত তার যে সম্পদ ছিল দেশ পরিচালনা করে তার কার্যকাল শেষ করার পর তিনি যখন হিসাব মিলাতে বসবেন তখন তিনি তার সম্পদের পরিমান দায়িত্ব নেয়ার আগে যা ছিল যদি তার থেকে কমে যায় তাহলে বুজতে হবে সততার কোষ্ঠী পাথরে তিনি উত্তীণ হয়েছেন। আর যদি সকলেই মৎস্য ব্যবসায়ী হয়ে বলে যে আমার মাছের খামার আছে আমি এমপি হওয়ার আগে আমার দশ টাকা ছিল এখন ৩শ টাকা হয়েছে ,তাহলে বুঝতে হবে সে একটা ডাকাত। আমরা ডাকাতমুক্ত একটা সমাজ গড়তে চাই। এটি শুধু রাজনীতিবিদদের জন্য প্রযোজ্য নয় রাষ্ট্রর যে যেখান থেকে সেবা দিবেন তাদের সকলের জন্য একই কথা প্রযোজ্য তিনি আরো বলেন ,সম্প্রতি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছে ,আমাদের কলিজার টুকরা এই ছেলেমেয়েদের প্রধান দাবি ছিল ,উই ওয়ান্ট জাস্টিস -আমরা সুবিচার চাই। সুবিচার যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে ,সেখানে ডাকাত এবং চোরের কোনো জায়গা নাই। যেখানে সম্পদ লুন্ঠন করে বিদেশে পাচারের কোনো সুযোগ নাই। যেখানে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে ঘুসের রমরমা বাণিজ্য চলবে না।
তিনি বিগত সরকারের নানা অপকর্মের কথা তুলে ধরে বলেন ,আগের সরকারের মন্ত্রীরা ,এমনকি অর্থ মন্ত্রী এক সময় বলতো ,ঘুষকে এখন ঘুষ বলা ঠিক হবে না এটাকে স্পিড মানি বলতে হবে। তারা ঘুষকে এভাবে জাতিয়করণ করেছিলেন ঘোষনা দিয়ে। আরেক মন্ত্রী বলতেন ,আপনারা মন্ত্রণালয়ে ঘুষ খাবেন কিন্তু একটু কম করে নিয়েন।
জাতীয় সংকটে সকলকে ঐকবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে জামায়াতে আমীর বলেন ,দল এবং ধর্ম যার যার কিন্তু দেশ আমাদের সবার। দেশের মৌলিক স্বার্থে দলগুলোর মধ্যে কোনো ধরণের বিভাজন এ জাতি কামনা করে না। সংকট এসেছে সংকট আসবে ,সংকট থাকবে। সকল জাতীয় সংকট ঐকবদ্ধ ভাবে আমরা মোকাবেলা করবো।
তিনি বলেন ,আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা ,আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ চাই। যে বাংলাদেশে প্রত্যেকটি নাগরিক ,একটি শিশুর জন্ম নেয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার সকল নাগরিক অধিকার তার নিকট তুলে দিতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে।
তিনি বলেন ,আমরা আমাদের যুবকদের হাতে কাগজ নামের কতগুলো সাটিফিকেট তুলে দিতে চাই না। বরং তাদের যোগ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে এ দুনিয়ার সাথে সকল চেলেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে যোগ্য এবং একটি মজবুত ভিত্তির উপর উন্নয়নের ভিত্তির উপর দাঁড়ানো একটি দেশ হিসাবে দেখতে চাই।
যুবকদের আমাদের সম্মান করতে হবে। ভালোবাসতে হবে। সমাজের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বের চাবি তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আমরা তারুণ্য নির্ভর একটি সমাজ দেখতে চাই। কোনো দেশ তরুণ সমাজকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে আগাতে পারে না।
বিচার প্রার্থী ন্যায় বিচারের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরবে না। তার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামই কেবল তার গ্যারান্টি দিতে পারে। ইসলাম বাস্তবে তা প্রমান করেছে। এমন একটি রাষ্ট্র আমরা গড়তে চাই ,দেখতে চাই। সেই কল্যাণ রাষ্ট্র ,সেই মানবিক রাষ্ট্রর অভিযাত্রী হিসাবে আমরা দেশবাসীর সহযোগিতা চাই ,দোয়া চাই , এবং পাশে চাই।