ভোটের মাঠে জামায়াত পূর্ণ উদ্যোমে

হুসাইন বিন আফতাব, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) : নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা অনুযায়ী শ্যামনগর উপজেলা নিয়েই পুনর্গঠিত হয়েছে সাতক্ষীরা-৪ আসন। দীর্ঘদিন কালিগঞ্জের আটটি ইউনিয়ন যুক্ত থেকে এ আসন গঠিত থাকলেও নতুন সীমানা পুনর্বিন্যাসে সেটি বাদ গেছে। ফলে একদিকে শ্যামনগরের প্রার্থীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন, অন্যদিকে কালিগঞ্জভিত্তিক নেতারা পড়েছেন বিপাকে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।

১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানে পাঁচটি সংসদীয় আসন ছিল। সে সময় শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় সাতক্ষীরা-৫ আসন। ২০০৮ সালে জেলার আসন সংখ্যা কমিয়ে চারটিতে আনা হলে শ্যামনগরের সঙ্গে কালিগঞ্জের আটটি ইউনিয়ন যুক্ত হয়ে তৈরি হয় সাতক্ষীরা-৪ আসন। সেই ধারা বজায় ছিল ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু সম্প্রতি সীমানা পুনর্র্নিধারণে শুধু শ্যামনগর উপজেলাকে সাতক্ষীরা-৪ আসন হিসেবে ঘোষণা করায় এ আসনে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে।

নতুন সীমানার আওতায় সাতক্ষীরা-৪ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৬ জন। দীর্ঘদিন ধরে এ আসনে পালাবদল ঘটেছে নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির শেখ আবুল হোসেন, ১৯৯১ ও ২০০১ সালে জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক, ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির এইচএম গোলাম রেজা, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের স ম জগলুল হায়দার এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আতাউল হক দোলন নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন খুলনা-১১ আসনে আওয়ামী লীগের মো. মোহাসীন, ১৯৭৯ সালে খুলনা-১২ আসনে বিএনপির ডা. আফতাবুজ্জামান ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির অধ্যক্ষ জিএম আব্দুল হক এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তবে এত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও স্বাধীনতার পর থেকে বিএনপি এ আসনে একবারও জয়ের মুখ দেখেনি। এই ব্যর্থতা ঘুচিয়ে প্রথমবারের মতো সাতক্ষীরা-৪ আসন জয় করে দলীয় চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে উপহার দিতে চায় বিএনপি। অপরদিকে কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ ও মাঠে অনুপস্থিত জাতীয় পার্টির সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া জামায়াত।

সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে একক প্রার্থী হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। তৃণমূল পর্যায়ে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন, পোলিং এজেন্ট প্রশিক্ষণ ও ব্যাপক প্রচারণার মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করেছে। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস ও ন্যায়ের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, “রাজনীতি মানে কেবল অবকাঠামো নয়; মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। মাদকমুক্ত সমাজ, কর্মসংস্থান ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের অঙ্গীকার।” তিনি দাবি করেন, অতীতে প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও জনগণের ভালোবাসাই তার মূল শক্তি।

বিএনপি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিপর্যস্ত হলেও অন্তত পাঁচজন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন মনোনয়নের দৌড়ে। এদের মধ্যে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. মনিরুজ্জামান মনির, শ্যামনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাস্টার আব্দুল ওয়াহেদ, কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আশেক এলাহি মুন্না, এবং জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তরুণ প্রার্থীরাও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

ড. মনিরুজ্জামান মনির জানান, তারেক রহমান তাকে তৃণমূলে গণসংযোগ ও দল সুসংগঠিত করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা তিনি বাস্তবায়ন করছেন। মাস্টার আব্দুল ওয়াহেদ তার দীর্ঘ সামাজিক সম্পৃক্ততা ও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতার কারণে আশাবাদী। আশেক এলাহি মুন্না জানান, ৩১ দফা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, আর দল যাকেই মনোনয়ন দিক, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। কাজী আলাউদ্দিন ও ইফতেখার আলী সীমানা পরিবর্তনের কারণে এখন দ্বিধায় থাকলেও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন।

শ্যামনগরভিত্তিক প্রার্থীরা অবস্থানগতভাবে সুবিধাজনক হলেও বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভাজন নিরসন না হলে তাদের জন্য জয় পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে হাজি মনির (মোস্তফা আল মামুন) মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এছাড়া এবি পার্টি প্রথমবারের মতো প্রার্থী দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার শেখ আবিদ হোসেন (রকি) এর নাম শোনা যাচ্ছে। উপজেলা এবি পার্টির উপদেষ্টা আসিফ মোহাম্মাদুল্লাহ (লায়ন) বলেন, এবি পার্টি জনগণের কাছে পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দিতে চায়। জয়-পরাজয়ের বাইরেও দলটি উন্নয়ন, যুবসমাজের কর্মসংস্থান ও আইনি সহায়তায় কাজ চালিয়ে যাবে।

সব মিলিয়ে সাতক্ষীরা-৪ আসনে প্রধান লড়াই গড়ে উঠছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। তবে জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো শক্তিশালী নতুন প্রার্থী ময়দানে নামলে সমীকরণ বদলে যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারণা ও সংগঠন গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির ভেতরকার বিভাজন ও প্রার্থীর ছড়াছড়ি তাদের দুর্বল করছে। অপরদিকে জামায়াত একক প্রার্থী গাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে মাঠে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, তৃণমূল পর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী এমপি হিসেবে কাজের ধারাবাহিকতা তাকে এগিয়ে রেখেছে। ফলে এবারের নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসনে গাজী নজরুল ইসলামের জয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক মহল।