রাষ্ট্রের বিভিন্ন পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাংলামোটরে দলের কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে পার্টির বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বিদেশী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পক্ষে তৎপর। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ মিলে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে ছাত্র জনতার আন্দোলনে পালিয়ে গেছে। আমরা দাবি জানিয়ে আসছি, আওয়ামী লীগের বিচার। কিন্তু ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য না পাঠিয়ে ভেরিফাইড ফেসবুকে বক্তব্য দেওয়ার আয়োজন করার সুযোগ করে দিয়েছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, অভ্যুত্থানের সাত মাস অতিবাহিত হলেও গণহত্যকারী শেখ হাসিনার বিচারের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করছি না। জাতি সংঘের মানবাধিকার কমিশন থেকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে গণহত্যার শামিল বললেও বিচারিক কাজের ধীরগতি অত্যন্ত নিন্দনীয়। এনসিপি বিচারকাজের দ্রুত অগ্রগতি দেখতে চায়।
তিনি উল্লেখ করেন সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই। আমরা তার এই বক্তব্যে নিন্দা জানাই। নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ কর্তৃক পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, আগ্রাসনবিরোধী হত্যাকাণ্ড, গুম খুন হত্যাকাণ্ডের বিচারের অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগেই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এধরনের বক্তব্য অনাকাক্সিক্ষত।
এনসিপি মনে করে বিচারের কার্যক্রমের পরিধি কার্যত দৃশ্যমান হতে হবে। আত্মপ্রকাশের পর থেকে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছি। বিচার, হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার এবং ক্ষমা প্রার্থনা অনুশোচনার আগে আওয়ামী লীগের পক্ষে যেকোন ধরনের তৎপরতা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সহায়তার শামিল। এনসিপি এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের নিশ্চয়তা চায়। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। এমনকি এই মাফিয়া গোষ্ঠীর যে কোন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন নাহিদ ইসলাম। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ কোন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দল নয়। এটি একটি ফ্যাসিবাদী দল। নির্বাচনের ভোটের মাধ্যমে দলটির পরাজয় ঘটেনি। আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী রেজিম বাংলাদেশ থেকে উৎখাত হয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর) সারজিস আলম, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণ) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখপাত্র সামান্তা শারমিনসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমি মনে করি রাজনীতিবিদরাই নির্ধারণ করবে দেশের ঘটনাপ্রবাহ বা রাজনীতি কোন দিকে যাবে। এটা রাজনীতিবিদদের কাছেই থাকা উচিত। সেই জায়গা থেকে আমাদের সন্দেহ হয়েছে বলেই আজ আমরা একত্রিত হয়েছি। তিনি জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে ফরমাল ইনফরমাল সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়। ১১ তারিখের মিটিংয়ে সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে নানা প্রস্তাব করেছেন বলেও জানান হাসনাত আবদুল্লাহ।
প্রসঙ্গত হাসনাত আবদুল্লাহর একটি স্ট্যাটাসে বৃহস্পতিবার ১১ মার্চ তিনিসহ আরও দুজনকে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রস্তাবের কথা তিনি তুলে ধরেন। হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমিসহ আরও দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায়। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝতার বিনিময়ে আমরা যেন এ প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়, এরই মধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। ফলশ্রুতিতে আপনারা দেখবেন গত দুইদিন গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের আরও বলা হয়, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে। আমাদের এ প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তাৎক্ষণিক বিরোধিতা করি এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করার কথা জানাই। উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোনো ধরনের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং ‘আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক’।
হাসনাত তার পোস্টে লেখেন, আলোচনার এক পর্যায় বলি-যে দল এখনো ক্ষমা চায়নি, অপরাধ স্বীকার করেনি, সে দলকে আপনারা কীভাবে ক্ষমা করে দেবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, ‘ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। (তোমরা কিছুই জানো না। তোমাদের প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার অভাব আছে। আমরা এখানে ৪০ বছর ধরে আছি।) তোমার বয়সের থেকে বেশি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে না।
তিনি আরও লেখেন, এর উত্তরে বলি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ইনক্লুসিভিটি হতে পারে না। আওয়ামী লীগকে ফেরাতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে ফেরাতে হবে। আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা হলে যে সংকট তৈরি হবে, তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে। পরে মিটিং অসমাপ্ত রেখেই আমাদের চলে আসতে হয়।
হাসনাত লেখেন, জুলাই আন্দোলনের সময়ও আমাদের দিয়ে অনেক কিছু করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো এজেন্সি কখনো বা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নানা ধরনের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করতে চাপ দেওয়া হয়েছে। আমরা ওসব চাপে নতি স্বীকার না করে আপনাদের তথা জনগণের ওপর আস্থা রেখেছি। আপনাদের সঙ্গে নিয়েই হাসিনার চূড়ান্ত পতন ঘটিয়েছি। আজকেও ক্যান্টনমেন্টের চাপকে অস্বীকার করে আমি আবারও আপনাদের ওপরেই ভরসা রাখতে চাই। এ পোস্ট দেওয়ার পর আমার কী হবে আমি জানি না। নানামুখী প্রেশারে আমাকে হয়তো পড়তে হবে হয়তো বিপদেও পড়তে হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো ধরণের আপস করার সুযোগ নেই।
তিনি লেখেন, জুলাইয়ের দিনগুলোতে জনগণের স্রোতে ক্যান্টনমেন্ট আর এজেন্সির সব প্রেসক্রিপশন আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ আবারও যদি আপনাদের সমর্থন পাই, রাজপথে আপনাদের পাশে পাই, তবে আবারও এই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ভারতীয় ষড়যন্ত্রও আমরা উড়িয়ে দিতে পারব। আসুন, সব যদি কিন্তু পাশে রেখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারলে জুলাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমাদের শহিদদের রক্ত আমরা বৃথা হতে দেব না। ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কামব্যাকের আর কোনো সুযোগ নেই বরং আওয়ামী লীগকে অবশ্যই নিষিদ্ধ হতেই হবে।