প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অ্যাপিলেট ডিভিশনের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি নির্দিষ্ট না করে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিদের মধ্যে ন্যূনতম দুই থেকে তিনজন রাখার রাখার প্রস্তাব করেছে বিএনপি। এছাড়া সব বিষয়ে গণভোটের বিপক্ষে তারা। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছে দলটি। একবার বিরতি দিয়ে পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে বলেও মত তাদের। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে সাংবাদিকদের কাছে আলোচনার অবস্থা জানাতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ একথা জানান।

সালাহ উদ্দিন বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিলো অ্যাপিলেট ডিভিশনের সিনিয়র মোস্ট যেন পরবর্তী চিফ জাস্টিস হন। আমাদের প্রস্তাব হয়েছে যে, এক্ষেত্রে একটা অন্তত অপশন থাকা উচিত, সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে কমছে কম দুই থেকে তিনজন যেন এই অপশনের মধ্যে থাকে। তবে সেই জায়গাটা (প্রস্তাব) এখনো গৃহীত হয় নাই সেটা আলোচনা চলছে।

প্রস্তাবের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু অসংহতি আগে দেখা গিয়েছে। সর্বক্ষেত্রে যদি আমরা ফিক্সড (নির্দিষ্ট) করে দেই, কোনো অপশন যদি না থাকে, ভবিষ্যতে যেহেতু আমরা জুডিশিয়ারির ফুল ইন্ডিপেন্ডেন্সটা এনসিউর করতে চাই। সেক্ষেত্রে আমরা বলব না, আগের মতো কিছু বিচারপতি যদি চিফ জাস্টিস হয়ে যান তাহলে রাষ্ট্রের জন্য এটা কল্যাণকর হবে না। আবারও বলছি, কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রর মধ্যে ডকট্রিন অব নেসেসিটি মেইকস ‘ল’ আমাদেরকে বুঝতে হবে। সেফটি অব দ্য স্টেট ইজ প্রায়োরিটি... সুপ্রিম ‘ল সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এবং ডকট্রিন অব নেসেসিটিটা বিবেচনায় রেখে কিছু অপশন এরকম রাখার সুবিধা। আর নাহলে হয়তবা কোনো ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্র পড়ে যাবে সেটা রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণকর হবে।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিষয়ে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়েও একমত হয়েছে বিএনপি। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের অষ্টম, নবম, দশম, দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বের অবস্থার কথা বলেছে তারা। ধর্মনিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করার সঙ্গে বিএনপি একমত। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আনার ক্ষেত্রেও তারা একমত। এগুলো মৌলিক অধিকারে আনার কথা বলেছে বিএনপি।

সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, পার্লামেন্ট হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, নি¤œকক্ষে ৪০০ আসন থাকবে, এর মধ্যে নারীদের জন্য ১০০ আসন রাখা এবং উচ্চকক্ষে ১০০ আসনের সুপারিশের বিষয়ে বিএনপি একমত।

বিভাগ পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে বিএনপি জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কথা হয়েছে। উনাদের প্রস্তাব হলো, স্থায়ী বেঞ্চ যেন বিভাগগুলোতে করা হয়। আপনারা জানেন যে, অষ্টম সংশোধনী ছিলো সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের সময়ে, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য যে বিধান আনা হয়েছিলো সংবিধানে, সেটা চ্যালেঞ্জড হয়ে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে যায় না এবং সাংঘর্ষিক.. যেহেতু এটার বিষয়ে বাতিল করে এটা জাজমেন্ট আছে সেজন্য আমরা বলেছি, সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের জন্য আর্টিক্যাল-১০০ এ প্রভিশন আছে যে, এটা ওপরে যেন কম্পালসন একটা আমরা আনতে পারি। জুডিশিয়ারিকে যেন আমরা এখানে কন্টিস্টিটিউশনে একটা প্রভিশন করতে পারি অথবা সাব সেকশন করতে পারি ওখানে যাতে করে প্রতিবছর প্রয়োজনীয় সংখ্যাক সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের জন্য এখানে একটা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায়। তাতে একই ফাংশনটা করা যাবে।

তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল এ্যাপয়েন্টমেন্ট অথবা জুডিশিয়াল এ্যাপুয়েন্টমেন্ট কমিশন’ একটা কমিশনের প্রস্তাব উনারা করেছেন। আমরা এটার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। বলেছি যে, এটা সংসদে আলোচনা করতে হবে। সংবিধানে একটা নতুন প্রভিশন যুক্ত করা প্রয়োজন হবে যাতে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের নিয়োগের ক্ষেত্রে কি কি বিধি-বিধান করতে হবে, এখন এখানে আলোচনা করছি না।

সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু সব কিছু আমরা আইননানুগভাবে এবং সাংবিধানিকভাবে করতে চাই। তিনি বলেন, বিচারক নিয়োগের যোগ্যতায় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপককেও যাতে বিচারক নিয়োগ করা যায়। আমরা বলেছি এ বিষয়টি প্রস্তাবিত আইন আছে অথবা এখন যে আইনটা করার চেষ্টা করছি বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ.. যেটা এখন হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জড রয়েছে বিভিন্ন কারণে। সেইটা নিষ্পত্তি হলে তখন আইনে করা যাবে। তবে আমরা এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত।

গতকাল বেলা ১১টা ১০ মিনিটে জাতীয় সংসদের এলডি হলে বিএনপি তৃতীয় দিনের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনায় বসেন। বৈঠকটি বিকালে সমাপ্ত হয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দলে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান ছিলেন।

জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন। কমিশন সদস্যদের বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী(ঐকমত্য) মনির হায়দার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

সব কমিশনকে সাংবিধানিক কমিশন করা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, উনারা বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানকে সাংবিধানিক কমিশন হিসেবে নিয়ে আসার জন্য প্রস্তাব করেছেন। মানবাধিকার কমিশন, দূর্ণীতি দমন কমিশন এবং আরও একটা কমিশন সৃষ্টি করার জন্য বলেছে, স্থানীয় সরকার কমিশন। আমরা বলেছি যে, প্রত্যেকটা কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এতে জটিলতা বাড়বে। বিদ্যমান আইনে প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেভাবে থাকা উচিত।

গণভোট প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা আগেও বলেছি, গণভোট সব বিষয়ে হবে না। সংবিধান সংশোধনের কিছু আর্টিক্যাল থাকে.. মানে প্রিয়াম্বল প্রস্তাবনা, মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে আর্টিক্যাল-৮,৪৮,৫৬ এবং ১৪২ যাতে সংবিধান সংশোধনীর বিভিন্ন উপায় বলা আছে। এইগুলো পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ সরকার গণভোট বাতিল করে দিয়েছিলো। পরে কোর্টে ভার্ডিক্টের মাধ্যমে ১৫তম সংশোধনী যেটাকে চ্যালেঞ্জ হয়েছে.. গণভোটকে রি-ইস্টিড করা হয়েছে, সেই বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে গণভোট হওয়া উচিত না। তবে আমরা প্রভিশন রেখেছি.. আমরা প্রস্তাব রেখেছি যে, ভবিষ্যতে পার্লামেন্ট যদি আরও কোনো কোনো আর্টিক্যালের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান রাখতে চায় সেটা ভবিষ্যত পার্লামেন্টের বিষয়।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা বিষয়টা আসলে টেকনিক্যাল.. আসলে এটা হচ্ছে কর্তৃত্বে মন্ত্রিসভা কর্তৃক পরিচালিত হবে সরকার, সেটা আগের বিধান যা আছে তা হলো। এখানে আমরা একমত নই বলতে পারেন। আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতে আমরা আর্টিক্যাল-৪৮ এর সাব সেকশন-৩ পরে আরেকটা নতুন আর্টিক্যাল আমরা প্রস্তাব করব। এখানে রাষ্ট্রপতির হাতে কি কি ক্ষমতা অর্পন করা যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা না করে রাষ্ট্রপতি কি কি ফ্যাংশন করতে পারেন সেটা ডিটেলড করা থাকবে। অনেক বিষয় থাকবে, এই মুহুর্তে আমরা ডিসক্লোজড করছি না। সেটা উনারা (কমিশন) মোটামুটি গ্রহন করেছেন বলে মনে হয়েছে। এখানে যাতে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনায়ন করা যায় এটা ব্যালেঞ্জড গভর্ণমেন্ট ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা যায়, সেই বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ সেই বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

প্রধানমন্ত্রী তিনটি পদে না থাকার প্রস্তাবে না জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, এখানে আছে, প্রধানমন্ত্রী যাতে তিনটি পদে না থাকে। প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা। এখানে সংসদে যে মেজরিটি পার্টির একটা সংসদীয় দল হয় তখন সেই দলটি ঠিক করে কে প্রধান মন্ত্রী হবেন। নেসেসারেলি যে, পার্টির চিফ হবেন এমন তো কথা নাই.. এরকম উদাহরণ অনেক আছে কিন্তু হওয়ার প্রভিশনটা অপশন রাখা উচিত। প্রধানমন্ত্রী যিনি হবে এটা দেখা যায় যে, সংসদের একটা ট্রেডিশন যে, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা হন। কোনো কোনো দেশে সংসদ নেতাকে আলাদাও করেছে এরকম এমন নজির আছে। কিন্তু এখানে সংসদ নেতা কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই, সংসদ রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো মন্ত্রণালয় লিড করেন তা নয়, এখানে (সংসদ) সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অবিচ্ছেদের অংশের মতো। ন্যাশনাল কন্সিটিউশন কাউন্সিল(এনসিসি), সংসদের উভয় কক্ষের মেয়াদ, সংসদ সদস্যের বয়স ২১ বছর করা, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিএনপির নেতারা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ১৪ জন, উপদেষ্টাবলীর কার্যাবলী, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে উপদেষ্টামন্ডলী থেকে একজনকে নির্বাচিত করা, উচ্চকক্ষ-সিনেট, নি¤œকক্ষ-জাতীয় সংসদ, এই দুই কক্ষের কার্যাবলী, দুই কক্ষের ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নেয়া, ন্যায়পাল নিয়োগ, রাষ্ট্রপতির অভিসংশন প্রক্রিয়া, লোকাল গভর্ণমেন্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্ধ না করা, শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে(আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে, জেলা পর্যায়ে এটর্নি সার্ভিস পরীক্ষামূলকভাবে(১০%) শুরু করা প্রভৃতি বিষয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা কমিশনের সুপারিশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হয়েছি। এখন কিছু কিছু বিষয় আছে আরও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।

স্থানীয় সরকারে কোনো সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কোনো পদে এমপিরা না থাকার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হলেও তা সংসদে আলোচনার একটু দাবি রাখে বলে জানান তিনি।

বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ১৫টি দলের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। বাকি দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা হবে। বিএনপি আশা করছে, তৃতীয় বৈঠকেই এ পর্যায়ের আলোচনা শেষ করতে পারবে।