ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেন উভয় সংকটে পড়েছে বিএনপি। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দলটি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রথম থেকেই তারা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। আগামী ডিসেম্বরেই সংসদ নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচারসহ অন্য ইস্যুগুলো নির্বাচিত সরকারের উপর দিতে চায় তারা। দলটির শীর্ষ নেতাদের সবাই বলছেন, দেশে নির্বাচিত সরকার আসলেই সংষ্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচারসহ সব কিছু করবে। কিন্তু গণঅভূত্থানের সাথে জড়িতদের প্রায় সবাই নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংষ্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচার দেখতে চায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সাথে একাধিকবার বৈঠক করে বিএনপি। সবশেষ গত শনিবারও দলটির শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেছেন। তবে বিদ্যমান ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের ফল নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানালেও প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে এবারো কোনো আশ্বাস পায়নি দলটি। বিএনপি এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে প্রধান উপদেষ্টা তার আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এমনকি আগামী জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাচন সম্ভব কি না, সে বিষয়েও সরকারপ্রধানের কাছ থেকে কোনো ইঙ্গিত পায়নি দলটি। এমন প্রেক্ষাপটে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো বার্তা না পেলেও বৈঠকে বিএনপির তরফ থেকে এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে, তারা ড. ইউনূসের পদত্যাগ চান না। তারা তার সম্মানজনক বিদায় চান। ড. ইউনূসের হাতেই দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটুক, তারা সেটাই চান। তবে সরকারকে চাপে রাখতে রাজপথে নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সরব থাকতে চায় দলটি।
জানা গেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার চলমান বৈঠক শেষে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ইস্যুতে সরকারের তরফ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটা দেখে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি। এখন পর্যন্ত দলটির অবস্থান হচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবিতে সভা-সমাবেশ-সেমিনারের মতো দলীয় বিভিন্ন ফোরাম থেকে তারা সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। এ জন্য আরও এক-দুমাস তারা সরকারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে। এই সময় পরে নির্বাচন নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা করা না হলে কিংবা নির্বাচন প্রলম্বিত করার কোনো লক্ষণ স্পষ্ট হলে তখন রাজপথের কর্মসূচির কথা ভাববে বিএনপি। এর পাশাপাশি চাপে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রাখবে তারা।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিএনপির। দলটি চায়, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সংস্কারকাজ সম্পন্ন করবে। এর বাইরে সংবিধান সংশোধনসহ রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জাতীয় সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে করার পক্ষে তারা। একই সঙ্গে প্রশাসনিক সচিব পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও রদবদলের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় দলটি। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সার্বিক কর্মকান্ডে রাজপথে থেকে চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে বিএনপি। সরকারকে চাপে রেখে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ আদায় করতে চায় তারা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাতক্ষীরায় দলীয় সমাবেশে ভার্চুয়াল বক্তব্যে বলেছেন, দেশের জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হলে, তাদের সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে হলে জনগণের সরকার দরকার। জনগণের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের ঠিকই পতন হয়েছে; কিন্তু আমাদের কাংখিতত লক্ষ্য, অর্থাৎ জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এখনও অর্জিত হয়নি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণের ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হবে, জনপ্রতিনিধিরা দেশের উন্নয়নে ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ না পাবে, ততক্ষণ বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। সবশেষ গত রোববার এক আলোচনায় তিনি বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন দিতে হবে, এটিই জনগণ দেখতে চায়। তা না হলে জনগণ তাদের দাবি আদায় করে নেবে। এই সরকার মানুষের দাবি শুনতে ও মানতে বাধ্য বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
জানতে চাইলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণের স্বার্থে প্রয়োজনে আবারও রাজপথে নামবে বিএনপি। সমস্ত ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিয়ে জনগণের সরকার আমরা প্রতিষ্ঠা করবই করব ইনশাল্লাহ। আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকেই দেবো। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনটা চাই। আমরা এখনো বলছি, আমরা এখনো রাস্তায় নামি নাই। আমরা মানুষের সঙ্গে আছি, আমরা মানুষের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করছি। সুতরাং আমাদেরকে কেউ বিপথে পরিচালিত করতে পারবে না, বাংলাদেশের মানুষকেও কেউ বিপথে পরিচালিত করতে পারবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিচির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত বিএনপি মাঠে থাকবে। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলাদেশের ১৮ কোটির মানুষের জন্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে না আনবো, ততক্ষণ আমরা রাজপথে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো। আমরা বাংলাদেশে রাজনীতি করবো নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পথে। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, বাকশালে বিশ্বাস করে না। বিএনপির শান্তির রাজনীতি করে, বিএনপি লগি-বৈঠার রাজনীতি করে না। তিনি আরও বলেন, বিএনপির এই আন্দোলন ক্ষমতায় যেতে নয়, ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য। বিএনপি সেই লক্ষ্যে রাজপথে আছে এবং থাকবে।
বিএনপির একাধিক নেতা মনে করেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণের দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে তারা। দলটির দাবি, ১৪ থেকে ২২ মে পর্যন্ত রাজধানীতে টানা কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠনের সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরও কার্যকর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দলটির পরবর্তী লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন আদায় করা। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে ঈদুল আজহার পর থেকে আরও সক্রিয় কর্মসূচির কথা ভাবছে বিএনপি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন ধরে রাখা বিএনপির জন্য ‘কঠিন হবে’ বলেও দলটি সম্প্রতি সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করতে হবে। এটিই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সাংবাদিক সম্মেলনে আরও বলা হয়, যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, তাই সংস্কার ও নির্বাচনপ্রক্রিয়া দুটোই একই সঙ্গে চলতে পারে।
সূত্র মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে টানা দুই দিন বৈঠক করলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, তা জেনে বিএনপি পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে। তবে রোডম্যাপ ও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার যে সিদ্ধান্ত আছে, তাতে অটল থাকবে দলটি। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত ও অবস্থান জানার পর আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে আলোচনা করবেন তারা। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবেবিএনপির পরবর্তী করণীয় নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, আগামী দশ-পনের দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়টা বিএনপি পর্যবেক্ষণ করবে।
বিএনপির এক নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত সবশেষ বৈঠকে তারা আশা করেছিলেন, সরকার বিদ্যমান ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে দূরত্ব ঘুচিয়ে আনবে এবং নির্বাচন নিয়ে আশ্বাসমূলক বার্তা দেবে। এর মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ নিয়ে যে শঙ্কা রয়েছে, সেটাও কেটে যাবে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি সে ধরনের কিছুই পায়নি। এতে তারা কার্যত হতাশ।
জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বিএনপির বক্তব্য ও অবস্থান সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। অন্য দলগুলোও তাদের বক্তব্য জানিয়েছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নির্বাচন যেমন চেয়েছে, তেমনি দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপও চেয়েছে। সুতরাং এখন সরকার কী করবে, তা তাদের পরিষ্কার করতে হবে। সেটি দেখেই আমরা পরবর্তী কর্মসূচি হাতে নিব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা আগের মতোই বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, এই সময়ের থেকে নির্বাচন এক দিনও পেছাবে না। তবে আমরা এখনো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতেই রয়েছি। বলেছি, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। আমরা এও বলেছি, সময়মতো এর ঘোষণা না পেলে প্রয়োজনে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।