খুলনা-৫ আসন (ডুমুরিয়া-ফুলতলা)

খুলনা ব্যুরো, ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা সংবাদদাতা : খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ১৪ টি এবং ফুলতলা উপজেলার ৪টি মোট ১৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসন। সংসদীয় আসন নং-১০৩। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে এবছর বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে-ময়দানে নির্বাচনি গণসংযোগ, ওয়ার্ড সভা, উঠান বৈঠক, ভোটার সমাবেশ, প্রতিনিধি সমাবেশ ও মহিলা সমাবেশসহ বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি পালন করছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হলেও বিএনপির রয়েছে একাধিক প্রার্থী। এছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের একজন ও খেলাফত মজলিসের রয়েছে একজন করে। তারা হলেন দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জামায়াত মনোনীত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার, ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশী খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি ও বিসিবির সাবেক সভাপতি বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আলী আসগর লবি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি শফি মোহাম্মদ খাঁন, হাতপাখা প্রতীকের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ডুমুরিয়া উপজেলা সহ-সভাপতি মাওলানা মুফতি আব্দুস সালাম, রিকশা প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের খুলনা জেলা সহ-সভাপতি ও ডুমুরিয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুফতি আব্দুল কাইয়ুম জমাদ্দার এবং দেয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে খেলাফত মজলিসের মুফতি আব্দুল জব্বার আযমী।

খুলনা নির্বাচন কমিশন অফিস সূত্রে জানা যায়, খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও গিলাতলা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা) এবারের মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৭০৩ জন। ভোটকেন্দ্র ১৫০টি এবং বুথ ৭৮২টি। দ্বাদশ নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৮৩ হাজার ২শ’ ৬৯ জন। এরমধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৯ হাজার ৪শ’ ৮১ জন। ফুলতলা উপজেলায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৭শ’ ৮৮জন। এ দুই উপজেলায় মোট হিন্দু ভোট প্রায় ৮৫ হাজার।

খুলনা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের দাপট খর্ব করে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। ২০০৮ সালে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে এবং ২০১৮ সালে জোটের শরীক হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। মামলা, জেল জীবন ও আত্মগোপনে থাকাবস্থায় সুযোগ পেলেই জনগণের নীবিড় সংযোগে ছিলেন। ফলে সাংগঠনিক শক্ত ভিত্তি বাড়তি শক্তি যোগাচ্ছে নির্বাচনি প্রচার প্রচারণায়। ইতোমধ্যে দুই দফা দলের আমীর ডা. শফিকুর রহমান এসেছেন খুলনায়। জনতার ঢল নামা জনসভায় জামায়াতের প্রার্থীদের জন্য ভোটারদের সমর্থন চেয়েছেন। মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দীর্ঘ ফ্যাসিবাদ সরকারের ১৫ বছরের প্রায় সাড়ে ৭ বছর আমি কারাগারেই ছিলাম। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময়ও আমি কারাগারে ছিলাম। ৬ আগস্ট বের হয়ে আমি সংগঠনের নির্দেশনা অনুযায়ী ফ্যাসিস্ট সরকারের ধ্বংস করা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়াসহ দেশের গুণগত ও কল্যাণমুখী পরিবর্তনে দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছি। জনগণ আমাদের এই কল্যাণমুখী রাজনীতি গ্রহণ করেছে। দীর্ঘ কারাবাসের ভিতরও যখনই একটু সময় পেয়েছি তখনই ফুলতলা-ডুমুরিয়ার জনগণের মানুষের মাঝে ছুটে এসেছি। খোঁজ খবর নিয়েছি এবং সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আসন্ন নির্বাচনে দল আমাকে ফুলতলা-ডুমুরিয়ার প্রার্থী হিসেবে আবারও মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি বলেন, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালে এমপি থাকাকালীন সময় আমি ফুলতলা-ডুমুরিয়ার রাস্তাঘাট, ড্রেন, কালভার্ট, মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, ঈদগাহ, শশ্মান, স্কুল, কলেজ, টিউবওয়েলসহ প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলাম। আগামীতেও উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। এছাড়াও সন্ত্রাস কবলিত এই ফুলতলা-ডুমুরিয়ার জনপদকে আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসমুক্ত করেছিলাম। বিভিন্ন বিলের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করা এবং আগামীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে দূর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত, দখলবাজমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, বেকারমুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সুখী সমৃদ্ধ ফুলতলা-ডুমুরিয়া উপজেলা গড়াই হবে আমার কাজ।

এদিকে জামায়াতের হেভিওয়েট প্রার্থীকে মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী প্রার্থী সংকটে ভুগছিলেন বিএনপি। ৫ আগস্টের পরে এই আসনে গণসংযোগ শুরু করেন যুবদলের জেলা শাখার আহবায়ক ইবাদুল হক রুবায়েদ। স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়া সত্বেও প্রথমে অঙ্গ দলের, পরে বিএনপির নেতাকর্মীরা তার সাথে নামেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ সভাপতি শফি মোহাম্মদ খান তার অনুসারীদের নিয়ে গণসংযোগ শুরু করেন। বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন শফি। এরপর দলের গ্রীণ সিগনাল পেয়ে প্রায় ১৭ বছর পর সাবেক রাষ্ট্রপতি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী পালনসহ খুলনার রাজনীতিতে সরব হন আলী আসগর লবী। এখন তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের গ্রীণ সিগনাল পেয়ে জামায়াতের হেভিওয়েট প্রার্থীকে মোকাবেলায় এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, বিসিবির সাবেক সভাপতি ও জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ মোহাম্মদ আলী আসগর লবী। ২০০১ সালে খুলনার রাজনীতিতে আবির্ভূত হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া খুলনা-২ (খুলনা সদর-সোনাডাঙ্গা) আসন থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হন। এই সময় মোহাম্মদ আলী আসগর লবী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। এ আসনটি খালেদা জিয়া ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে আলী আসগর লবী নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালের ১/১১ সরকারর আমলে সবেক এমপি আসগর লবী গ্রেফতার হন। বন্ধ করা হয় তার সব ব্যাংক একাউন্ট।

মোহাম্মদ আলী আসগর লবী বলেন, বিগত জোট সরকারের সময়ে আমি খুলনা-২ (খুলনা সদর-সোনাডাঙ্গা) আসনের এমপি ছিলাম। খুলনা সদরে আমি ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলাম। এবার আমি আমার নিজ এলাকার মানুষের ভাগ্যন্নয়নে খুলনা-৫ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আমি এলাকায় এলাকায় মানুষের কাছে যাচ্ছি, মানুষের দূর্ভোগ শুনছি, জনগণও আমাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে। জলাবদ্ধতা নিরসন, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নসহ অবহেলিত ফুলতলা-ডুমুরিয়াকে একটি মডেল আসন হিসেবে গড়ে তোলাই হবে আমার মূল লক্ষ্য।

বিএনপির অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী শফি মোহাম্মদ খাঁন বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর ফ্যাসিবাদী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই আন্দোলন সংগ্রামে ছিলো না। ১৯৯০ সাল থেকে ছাত্রদলের রাজনীতি শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ফজলুল হক মুসলিম হলের সভাপতি এবং সর্বশেষ আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেছি। ফলে নিয়ম ঠিক থাকলে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। এ সময় তিনি আরো বলেন, লবি সাহেব ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে চলে যান এবং উনি দূর্নীতির মামলায় ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি বলেও উল্লেখ করেন। ফুলতলা-ডুমুরিয়ার উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার পিতা যেমন এলাকার উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং বিপদে আপদে সবসময় সমাজের মানুষের পাশে থাকতেন, আমি এ ধারা অব্যাহত রাখতে চাই।

তবে বিএনপির সাবেক এমপি ডা. গাজী আব্দুল হক মনোনয়ন প্রত্যাশীর আভাস দিলেও তাকে কোন ধরণের প্রচার-প্রচারণায় এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। এছাড়া খুলনা জেলা যুবদলের আহ্বায়ক ইবাদুল হক রুবায়েদ ২৪ এর ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর এই আসনে মনোনয়নের ব্যাপারে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে তাকে আর মাঠে-ময়দানে দেখা যাচ্ছে না।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ডুমুরিয়া উপজেলা সহ-সভাপতি মাওলানা মুফতি আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের পীর সাহেব সৈয়দ রেজাউল করিম হুজুরের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি এই আসনের প্রার্থী হিসেবে কাজ শুরু করেছি। আমরা ন্যায় ও ইনসাফের সাথে কুরআনের হুকুমত প্রতিষ্ঠা এবং সে অনুযায়ী ফুলতলা-ডুমুরিয়াকে সাজাতে চাই।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের খুলনা জেলা সহ-সভাপতি ও ডুমুরিয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মুফতী মুহাম্মদ কাইয়ুম জমাদ্দার বলেন, আমার লক্ষ্য অফিস-আদালত ও স্থানীয় প্রশাসনকে দুর্নীতি-মুক্ত, প্রয়োজনীয় পরিষেবা বাস্তবায়নকারী ও স্বচ্ছভাবে কাজ করা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা, রাস্তাঘাট নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা; সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলবাজি দূর এবং জলাবদ্ধতা নিরসন করে নাগরিকদের জীবন-যাত্রার মান সহজ করা।

খেলাফত মজলিসের মনোনয়ন প্রত্যাশী মুফতী আব্দুল জব্বার আজমী বলেন, সংগঠন আমাকে খুলনা-৫ আসনে কাজ করতে বলেছে। আমি ইতোমধ্যে গণ-সংযোগ শুরু করেছি। জলাবদ্ধতাসহ ফুলতলা-ডুমুরিয়ার প্রয়োজনীয় উন্নয়ন করা হবে আমার মূল কাজ।

উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীনের পর থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মরহুম সালাহউদ্দিন ইউসুফ ৩ বার পর্যায়ক্রমে এমপি ও মন্ত্রী, এরশাদ সরকারের আমলে লে.ক. এ এইচ এম আব্দুল গফফার একবার মন্ত্রী, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে বিএনপির ডা. গাজী আব্দুল হক একবার এমপি হন। ২০০০ সালের ৬ অক্টোবর তার মৃত্যু পর একই বছর ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সর্বপ্রথম এমপি নির্বাচিত হন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। ২০০১ অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রার্থী মিয়া গোলাম পরওয়ারের কাছে তিনি হেরে যান। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালে বিতর্কিত অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ অনুষ্ঠিত একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এমপি হন। তিনি মৎস্য ও ভুমি প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।