স্টাফ রিপোর্টার : লাখো তরুণের সমাবেশ এবং জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে আত্মপ্রকাশ ঘটলো নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি’- ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি এনসিপি’র। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও ডাকসুর সাবেক নেতা আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে গঠিত দলের নাম ঘোষণা করেন শহীদ ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার।
এদিন সন্ধ্যায় সমাবেশ থেকে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ঘোষণাপত্রে বলা হয় -জুলাই ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে, আমরা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এই মর্মে ঘোষণা করছি। আমরা হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। তবে শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। তথাপি স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। বরং বিগত ১৫ বছর দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে।
“জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাক্সক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছি। এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।
আমরা মনে করি, জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবো।
আমরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চাই যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোন স্থান হবে না।
আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে। আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সকল নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনও অংশকেই অপরায়ণ করা হবে না। বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
“অর্থনীতিতে, আমরা কৃষি-সেবা-উৎপাদন খাতের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই যেটি হবে স্বনির্ভর, আয়-বৈষম্যহীন ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল। আমাদের অর্থনীতিতে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হবে না, বরং সম্পদের সুষম পুনর্বণ্টন হবে আমাদের অর্থনীতির মূলমন্ত্র। আমরা বেসরকারি খাতের সিন্ডিকেট ও গোষ্ঠীস্বার্থ নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ভোক্তা ও জনস্বার্থ সংরক্ষণ করবো। অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করবো এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি খাতে জোর দিয়ে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি টেকসই, আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তুলবো।
পরিশেষে, আমরা একটি ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের সংকল্প আবারও পুনর্ব্যক্ত করতে চাই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই বিজয় নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণেরও শপথ। চলুন আমরা একসঙ্গে, হাতে হাত রেখে, এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখনই সময় নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার!
এই নতুন বাংলাদেশ গড়ায় আমরা সবাই প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে শপথ করি। ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের কাক্সিক্ষত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাই। আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক অধরা কোন স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা।
দলের সংক্ষিপ্ত কমিটি ঘোষণা করেন নতুন সদস্য সচিবের দায়িত্ব পাওয়া আখতার হোসেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি’র দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা ও নাহিদা সরোয়ার নিভা, প্রধান সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) পদে হাসনাত আবদুল্লাহ ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) পদে সারজিস আলমের নাম ঘোষণা করেন তিনি।
নতুন এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, মহানগর উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতির জোনায়েদ সাকি, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক ও বিদেশী অতিথিরাও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর কামরান দাঙ্গাল ও ঢাকায় ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূত।
এর আগে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতেই পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। পরে পবিত্র গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। পরে মহান মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আখতার হোসেন বলেন, নতুন বাংলাদেশে নতুন সংবিধান হবে। সেইসাথে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচার করা হবে।
সামান্তা শারমিন বলেন, আজকের দিনকে মানুষ মনে রাখবে। কারণ ৫৩টি বছর দেশের মানুষকে বাইনারি পলিটিক্সে রেখে দিয়েছিল। এজন্য আমরা নাগরিক অধিকারের কথা ভুলতে বসেছিলাম। ২০২৪ সাল নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পারছি। এতোদিন আমরা দেখেছি রক্তের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল, নতজানু পররাষ্ট্রনীতির দেশ। এজন্য নতুন রাজনীতির দরকার। দুর্নীতি মুক্ত, বিভেদহীন দেশ গড়তে নতুন দেশ দরকার। ২৪ এর অভ্যুত্থান আমাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।
সারজিস আলম বলেন, নতুন দেশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশের মানুষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকলে পরপস্পরের প্রতি সম্মান দেখালে বাংলাদেশ অদম্য হয়ে উঠবে। এসময় তিনি পুলিশ থেকে বিচারক সবাইকে ঘুস দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি রাজনীতিবিদদের সামান্য স্বার্থের জন্য কোন দুর্নীতিবাজের জন্য সুপারিশ না করার আহ্বান জানান।
পিলখানা এবং শাপলা চত্বরে হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামী দিনে গণভবনে কে যাবে তা নিশ্চিত করবে খেটে খাওয়া জনতা। আজকের তরুণেরা কমিটেড, আগামী দিনে সুশাসন নিশ্চিত করা হবে। সেইসাথে বিভাজনের রাজনীতি বাদ দিয়ে ঐক্যের রাজনীতি চালু করা হবে।
নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি বলেন, নতুন দলে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা মিলেমিশে কাজ করবে।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল, আবদুল হান্নান মাসউদ, নূসরাত তাবাসসুম, শহীদ রাজীবের বাবা, ডা. তাসনিম জারা প্রমুখ।