গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার আবেদন জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। হোসাইন মোহাম্মদ আনোয়ার নামে বংশালের এক ব্যক্তি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে এই আবেদন করেন। এছাড়া গতকাল রাজধানীর পল্টনসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ফ্যাসিস্টদের দোসর হিসেবে খ্যাত জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবিতে কর্মসূচি পালন করা হয়। ইসিতে জমা দেয়া আবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে সুষ্ঠু ও কলুষমুক্ত রাখার স্বার্থে এবং সংবিধানের আলোকে জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক কর্মকা- ও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিষিদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সূত্র মতে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হওয়ার পেছনে জাতীয় পার্টিরও অন্যতম দায় রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তথাকথিত তিনটি নির্বাচনে এ দলটির অংশগ্রহণ শেখ হাসিনার সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দলটি। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থেকে দলটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ক্ষমতার অংশীদার হয়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন জাতীয় পার্টির নেতারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মতো জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনার অধীনের নির্বাচন বর্জন করলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারত। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ না নিলে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না বলে তারা মনে করেন।

রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ ও একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নানা সময়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছে। শুধু তা-ই নয়, দলটি গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনা, সামরিক শাসনের উত্তরাধিকার বহন, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অপব্যবহার এবং জনস্বার্থবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। এ দলটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে গণতন্ত্রের মূলধারাকে ক্ষুন্ন করেছে এবং বারংবার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার ইতিহাসে জড়িত থেকেছে। বর্তমানে জাতীয় স্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক দলকে বৈধতা দেওয়া জনস্বার্থবিরোধী।

সূত্র মতে, গত ১৭ বছরের দুঃশাসনের কারণে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এরপর ছাত্র আন্দোলনের মুখে বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে তার সব রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে নিষিদ্ধ করে। তবে জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদ মাফিয়া শেখ হাসিনার সব রাজনৈতিক কর্মকা-কে বৈধতা দেওয়ার দোসর হিসেবে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, জাতীয় পার্টির সমর্থনের কারণেই আওয়ামী লীগ দেশে একতরফা নির্বাচন করে গেছে। তারা জাতীয় পার্টিকে গ্রহপালিত বিরোধী দলে পরিণত করেছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনীতিতে জাপার নেগেটিভ ভূমিকার কারণে অনেক আগেই দলটির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিল।

জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকর্মী বলছেন, আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হিসেবে জাপাকে একটি পক্ষ নিশানা বানিয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের অনেক কর্মকা-ের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছে তারা। তাদের সাবেক চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ মামলার কারণে রাজনীতিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এরশাদ অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিলে তাকে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দলকে বারবার বিভক্ত করেছিল তৎকালীন সরকার।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, শুধু জাতীয় পার্টি নয়, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে ১৪ দলকেও নিষিদ্ধের আওতায় আনতে হবে। এ দেশে গণতন্ত্র হত্যার জন্য, গণহত্যার জন্য এসব দল সমভাবে দায়ী। তাই তাদের এ দেশের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, জাতীয় পার্টি একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি, যার রাজনৈতিক অঙ্গনে এককভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই। তিনি বলছেন, অনেক দিন ধরেই দলটি মূলত একটি আঞ্চলিক দল কিন্তু সেটিও তারা ধরে রাখতে পারেনি।

সূত্র মতে, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে তাদের মিত্র দল জাতীয় পার্টি। কয়েকমাস চুপচাপ থাকার পর কাকরাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিরোধের ঘোষণার পর ওই এলাকায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। যে কারণে জাতীয় পার্টি তাদের কর্মসূচিও স্থগিত করে। এরপর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ও শ্রমিক আন্দোলন ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের’ সহযোগী হিসাবে দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স জাতীয় পার্টিকে একটি স্বৈরাচারি দল উল্লেখ করে তাদের রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। সেসময় গণ অধিকার পরিষদের প্রধান নুরুল হক নুর বলেন, যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর এবং সহযোগী ছিলো তাদের নিষিদ্ধের দাবি জানাই আমরা।

সূত্র মতে, এনসিপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, জাতীয় পার্টিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করার প্রক্রিয়া চলছে। জুলাই বিপ্লবে অংশ নেওয়া নেতারা মনে করেন, ফ্যাসিবাদের অন্যতম সহযোগী ছিল জাতীয় পার্টি। স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ তাদের সহযোগী জাতীয় পার্টির সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই দাবির মধ্যে সম্প্রতি গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের উপর জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে নৃশংস হামলার পর জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা আরও জোরালো হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে জুলাই মঞ্চ। ‘মার্চ টু জাতীয় পার্টি অফিস’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এটা ঠিক, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য দায়ী। সেটার জন্য তার শাস্তি হতে পারে।

গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগের অপকর্মের জন্য ১৪ দল ছাড়াও জাতীয় পার্টি সমান অংশীদার। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আর ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা গেলে জাতীয় পার্টিকেও করা যায়।

জানতে চাইলে এ প্রতিবেদককে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জাতীয় পার্টিসহ যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে সমর্থন ও ফ্যাসিবাদের বয়ানে সুর মিলিয়েছে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে জিএম কাদের ভারতে গেলেন। তখন সাংবাদিকরা তাকে (জিএম কাদের) প্রশ্ন করলেন যে, আপনার সঙ্গে কী কথা হলো। তখন জিএম কাদের বলেছেন যে, ওদের (ভারত) পারমিশন ছাড়া কিছু বলতে পারব না। এই হচ্ছে জাতীয় পার্টি। তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু শেখ হাসিনার আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে কারা রক্ষা করেছে, কারা ১৬ বছর জনগণের লক্ষ কোটি টাকা পাচারের সুবিধা করে দিয়েছে। কারা এই দেশকে আওয়ামী ভয়ঙ্কর স্বেচ্ছাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব পালন করেছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে জাতীয় পার্টি। যারা ফ্যাসিবাদকে সমর্থন ও ফ্যাসিবাদের বয়ানে সুর মিলিয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। জনগণ তাদের বিচার দেখতে চায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গী ছিল এই জাতীয় পার্টি। ফ্যাসিবাদের জন্য আওয়ামী লীগের মতো তাদেরও সমান দায় রয়েছে উল্লেখ করে দলটিকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত বলে তারা মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি নিষিদ্ধের দাবিও তোলা হয়েছে।

সূত্র মতে, ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, দলীয় অনুগতদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনের আগে দলদাস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজানোর প্রেক্ষাপটে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। কেবল আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত কয়েকটি দল দলীয় সরকারের অধীনের ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্জনের ঘোষণা দিলেও পরে নির্বাচনে অংশ নেয়। শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এ দলটি। দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা যে তথাকথিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করেছিলেন, সেখানেও জাতীয় পার্টিকে জায়গা দেওয়া হয়। ওই সরকারে রওশন এরশাদ, এবিএম রহুল আমীন হাওলাদার, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সালমা ইসলাম ও মুজিবুল হক চুন্নুকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। আর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ বলেন, জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদের দোসর এবং সুবিধাভোগী এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে। তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বরং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। অন্য দলগুলোর মতো জাতীয় পার্টিও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলে ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভিন্ন হতো কি না জানি না। তবে নিঃসন্দেহে জনতার শক্তি বৃদ্ধি পেত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ যতটুকু দায়ী, জাতীয় পার্টির দায় তার তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে গত তিনটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা তারা করেছে। জাতীয় পার্টিকে আইনি ও বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার আওতায় নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।