বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে। নির্বাচনের সময় ঘোষণাকে ইতিবাচক বলা হলেও, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই ‘জুলাই সনদের’ আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে সেই আলোকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, সারা দেশে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের অনুকূলে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ অবাধ ও নির্বিঘে্ণ নিজেদের ভোট প্রয়োগ করতে পারলে ইসলামী আদর্শের শক্তিকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করবে।
তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট-বাকশালী আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্ন একটি দেশের প্রেসক্রিপশনে ক্ষমতায় এসে দেশের আলেম-ওলামাদের ওপর জেল-জুলুম চালিয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের লজ্জাজনক পতন হয়েছে। তাই আগস্ট বিপ্লবকে অর্থবহ ও টেকসই করতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ বাংলাদেশের অতীতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অবিলম্বে জুলাই জাতীয় সনদের প্রণয়নের কাজ সুসম্পন্ন করে বর্তমান সরকারকেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এই সনদের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার আহবান জানান।
বুধবার (১৩ আগস্ট) সকালে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আরাফাত আবাসিক এলাকায় উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ভোটার সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ আহবান জানান।
আরাফাত নগরের চকমথুরাবাদ ভোট কেন্দ্র কমিটির সভাপতি মো. মতিউর রহমান হাওলাদারের সভাপতিত্বে ও হরিণটানা থানার ৪ নং ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি মো. আমির হোসাইনের পরিচালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য খুলনা জেলা সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি মুন্সি মঈনুল ইসলাম ও মিয়া গোলাম কুদ্দুস, ডুমুরিয়া উপজেলা আমীর মাওলানা মোক্তার হোসেন, হরিণটানা থানা আমীর আব্দুল গফুর, ডুমুরিয়া উপজেলা নায়েবে আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর হরিণটানা থানা নেতা হারুন অর রশীদ ও উপজেলা হিন্দু কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ দেবক প্রসাদ। অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন সোনাডাঙ্গা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা জাহিদুর রহমান নাঈম, খুলনা জেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহকারী সেক্রেটারি আল আমিন গোলদার, হরিণটানা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি এডভোকেট ব ম মনিরুল ইসলাম, মো. সেলিম বাহার, মো. মশিউর রহমান রমজান, মাওলানা ইমরান হোসেন, ডা. মো. ইসমাঈল হোসেন, মো. রফিকুল ইসলাম, রাসেল গাজী, আব্দুল বারেক মোল্লা, মো. শহিদুল, মো. কামাল হোসেন, মো. মুজাদিুল ইসলাম, মো. মজিবুর রহমান, হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহিম প্রমুখ। এই সমাবেশের প্রধান অতিথি মিয়া গোলাম পরওয়ারের হাতে ফুল দিয়ে ইউপি মেম্বর আবুল কালাম, সোলায়মান কাজী, বাচ্চু সরদার, বিশিষ্ট সমাজ সেবক আবু বকর ও সালাহউদ্দিনসহ বিভিন্ন দল থেকে ২০/২৫ জন নেতাকমী জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন।
রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পতিত স্বৈরাচারের অনুসারীরা সক্রিয় রয়েছে বলে মন্তব্য করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘তাই ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আসন্ন নির্বাচনে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে হবে। আগামী নির্বাচনে দেশে ভোট বিপ্লব ঘটানোর জন্য নেতা-কর্মীদের এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন ইসলামী দলগুলোকে নেতৃত্বের আসনে দেখতে চায়। দেশে ইসলামের পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অচিরেই জনগণের সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে, ইনশা আল্লাহ। কোনো ষড়যন্ত্রই জনতার বিজয়কে ঠেকাতে পারবে না।’ এখন দু’টি শ্লোগান মানুষের মুখে মুখে একটি হলো নতুন বাংলাদেশ আর অপরটি হলো দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
তিনি বলেন, আমাদের আকাঙ্ক্ষা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন দ্রুত সম্পন্ন করে অধ্যাদেশ, এলএফও বা গণভোট এর মাধ্যমে আইনি ভিত্তি প্রদান করা না হলে অন্তবর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বিফলে যাবে। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে স্বৈরাচারের দোসরদের মুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সকল স্তরে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, বাংলাদেশের আপামর জনতা জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যে প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল তা পূরণ না হওয়ায় জনগণের মাঝে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। শহীদ ও আহতদের পরিবারসহ জুলাই যোদ্ধাদের মাঝে নতুনভাবে উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা কী হবে তা জাতির কাছে অস্পষ্ট।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। এ জন্য ৬টি কমিশন গঠন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে দু’পর্বের দুই মাসেরও অধিক কাল যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এবং ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ নেই। ঘোষণায় কখন কীভাবে তা কার্যকর করা হবে তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বিগত ১৬ বছরের জুলুম, নিপীড়ণ, গুম-খুন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা অনেক স্বৈরশাসকের পতন দেখেছি, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনতার অনেক সংগ্রাম দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশের ২৪ এর সরকার পতনের যে দৃশ্য, সেটা একেবারেই ব্যতিক্রম। এই কৃতিত্ব জনগণেরই। সকল রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক, হকার, শ্রমিক শেষ দিকে জুলাইতে এসে আন্দোলনটা এমন একটা সার্বজনীন রূপ লাভ করে যা আগে কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, আবারো যেন সেই দুঃশাসন ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য দেশে ইনসাফপূর্ণ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম হবে-সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল জনগণের। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সভা-সমাবেশ করার অধিকার, বাক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আপামর জনসাধারণ। সেই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই জনগণ বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। জুলাই আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনাকে ধারণ করে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদের দাবি সর্বমহলের বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এর আগে সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সকাল ৯ টায় রায়ের মহলে লাইন বিল পাবলা ভোট কেন্দ্রের ভোটার সমাবেশে, বিকেল ৪ টায় পূর্ব বিলপাবলা ভোট কেন্দ্রে ভোটার সমাবেশে ও সন্ধ্যা ৭টায় খানজাহান থানা কার্যালয়ে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, আগেও চাঁদাবাজি হয়েছে এখনও হচ্ছে। আওয়ামী লীগ লগি বৈঠার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। এখনো আরেক গ্রুপ সেই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় যেতে চায়। এদেরকে প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। জামায়াত সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়তে চায়। এ জন্য দরকার সোনার মানুষ। সোনার মানুষ কারা সেটি অতীতে প্রমাণিত হয়েছে। জনগণ সেটি মূল্যায়ন করবে ইনশাআল্লাহ। সব দলের শাসন দেখা হয়েছে এখন জাতি নতুন কিছু দেখতে চায়। আরও বলেন, অতিথি পাখিরা ডুমুরিয়া-ফুলতলার উন্নয়ন করতে পারবে না। এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন এখানকার মানুষের নাড়ীর সম্পর্ক যার সাথে সেই মিয়া গোলাম পরওয়ারকে। মওসুমী পাখিরা নির্বাচনের সময় শুধু ভোট নিতে পারবেন । কিন্তু এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন না।