দেশব্যাপী মিলাদ-দোয়া মাহফিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে গতকাল শুক্রবার দলের চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে বিএনপি। দোয়া মাহফিল থেকে অসুস্থ বেগম জিয়ার দ্রুত সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে মিলাদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রাজধানীতে বিভিন্ন মসজিদে ও এতিমখানা-মাদরাসায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের জন্মদিন উপলক্ষে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভার আয়োজন করে। এদিকে খালেদা জিয়াকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আজকে জন্মদিন। তিনি কোনো অনুষ্ঠান পালন করেন না। তবে দল থেকে সারাদেশে মিলাদ-দোয়া মাহফিল পালন করা হয়েছে। শুক্রবার বিকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ম্যাডামের জন্য ফুলের তোড়া পাঠিয়েছেন। তার কর্মকর্তারা এটা গুলশানের বাসায় নিয়ে এসেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব সজীব এম খায়রুল ইসলাম ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম গতকাল বিকাল ৪টায় গুলশানে বাসা ‘ফিরোজা’য় চেয়ারপার্সনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তারের কাছে প্রধান উপদেষ্টা ফুলের তোড়া হস্তান্তর করেন। এই সময়ে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বেলায়েত হোসেন, মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান, চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত উইংয়ের কর্মকর্তা মাসুদ রহমান উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে চীনা রাষ্ট্রদূতের পক্ষে জন্মদিনে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছেন চীনা দূতাবাস।
মিলাদ ও দোয়া : খালেদা জিয়াকে কারাগারে চরম নির্যাতন করা হয়েছে অভিযোগ করে এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন মির্জা আব্বাস। গতকাল সকালে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় এক মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এই দাবির কথা বলেন।
তিনি বলেন, কারাগারে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের যেই কক্ষে রাখা হয়েছে সেই কক্ষে ইঁদুর দৌড়দৌডি করতো, পোঁকামাকড় দৌড়াদৌড়ি করতো। কয়েকজন ডেপুটি জেলর, জেলর অন্যায়ভাবে তাকে ছাদের ওপরে একটি কক্ষে রেখেছিলো। আজকে আমি এই অনুষ্ঠান থেকে বেগম খালেদা জিয়ার জেলজীবনে তার ওপরে যে অত্যাচার হয়েছে, যে নির্যাতন হয়েছে, কারা কারা এর সঙ্গে দায়ী তাদের সকলের একটা বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি এবং এর বিচার হওয়া উচিত।
বিএনপির দুর্দিনে দলের নেতৃত্ব দিয়ে খালেদা জিয়া যে ভূমিকা রেখেছেন তা তুলে ধরে মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা যারা কয়েকজন তাদের সাথে কাজ করেছি তারা দেখেছি, নানা চাপের মধ্যে দেশনেত্রীকে আমরা দেখেছি দৃঢ় মনোবল। গণতন্ত্রের প্রশ্নে তার আপোষহীন নেতৃত্ব এবং নেতাকর্মীদের প্রতি তার যে ভালোবাসা ও স্নেহ তা তুলনাহীন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সঞ্চালনায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এই মিলাদে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ফজলুল হক মিলন, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, মীর সরফত আলী সপু, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সাইফুল আলম নিরব, আসাদুল করীম শাহিন, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, মহানরগর দক্ষিণ বিএনপির রফিকুল আলম মজনুসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ভোট গণনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা বিরাজ করবে। এখনো গণতন্ত্র নাগালের বাইরে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে নির্বাচন হবে। তবে ভোট গণনার আগ পর্যন্ত তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাবে। নেতাকর্মীদের সতর্ক করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র চলছে, তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে এবং কোনো প্রকার ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির চেয়ারপারসন নন, তিনি জাতির অভিভাবকও। গণতন্ত্রের জন্য তিনি অবিরাম লড়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কখনো জন্মদিন উদযাপন করতেন না, দলের পক্ষ থেকেই এ আয়োজন করা হতো।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংস্কার সংস্কার করে কালক্ষেপণ করলে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে, মহাবিপদ ডেকে আনবে। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের সংস্কার আমরা দেখেছি। সে সংস্কারের পর শেখ হাসিনার দানব সরকার এনেছিল। জাতি পেয়েছিল ভয়ংকর দুঃশাসন। খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত দোয়া মাহফিলে এ কথা বলেন তিনি।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানির সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রাজিক আহসানের পরিচালনায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। এ সময় ইয়াসিন আলী, ডা. জাহিদুল কবিরসহ স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করেছে শাহবাগ থানা ছাত্রদল। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ী আবাসিক এলাকায় বাদ জুমা দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে শাহবাগ থানা শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব শাকিল হোসেন সাদ্দামের নেতৃত্বে ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। শিববাড়ী মসজিদের খতিব মিলাদ পরিচালনা করেন।
আলোচনা সভা : যদি এই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আল্লাহ ছাড়া কেউ ধানের শীষকে রুখতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়াপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ কর্মজীবী দল কর্তৃক আয়োজিত বেগম জিয়ার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের যে ট্রেন চালু হয়েছে, তাতে আপনারা মানুষের সমর্থন তখনই পাবেন যখন বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করবেন। গ্রামে যারা অত্যাচার করে, তাদের রুখে দেবেন। পদ নয় বরং দলকে ভালোবাসবেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী বিরোধী যারা বুকের রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে দেশের মানুষ সেটা রুখে দেবে। এই দেশটা এখন জনগণের। এটা এখন আর হাসিনার বাংলাদেশ নয়। এখন বিচারকের আদালতে আর লাথি মারা হবে না। আমার ভোট এখন আমিই দেব, যে ভোটের জন্য আমরা আত্মাহুতি দিয়েছি। যদি এই দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আল্লাহ ছাড়া কেউ ধানের শীষকে রুখতে পারবে না।
২০০৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতিদমন কমিশনের মামলায় দন্ডিত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। পুরোনো কারাগারে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিনা চিকিৎসায় বন্দী রাখার ফলে বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করলেও বার বার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদন তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার নাকচ করে দেয়।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে খালেদা জিয়া চতুর্থ। বাবা এস্কান্দর মজুমদার, মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। পৈত্রিক নিবাস ফেনীর ফুলগাজী হলেও তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দিনাজপুরে বাবার কর্মস্থলে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখেন গৃহবধূ খালেদা। প্রথমে দলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে তিন দফা বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন খালেদা জিয়া।