ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে জুলাই ঐক্যের মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের আন্দোলনকে ‘চরমপন্থি গোষ্ঠী’র আন্দোলন বলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে জুলাই ঐক্য। এই বক্তব্যের জবাব চাইতে সরকারকে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটা দিয়েছে শতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেশার গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা জুলাই ঐক্য।
বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই আল্টিমেটাম দেয় জুলাই ঐক্য মোর্চা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ডাসুর সমাজ সেবা সম্পাদক ও জুলাই ঐক্যের সংগঠক এবি জুবায়ের।
লিখিত বক্তব্যে জুবায়ের বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে জুলাই ঐক্যের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ‘চরমপন্থি গোষ্ঠী’র আন্দোলন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা ভারতের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। জুলাইয়ের স্পিরিটকে ধারণকরা মোর্চা জুলাই ঐক্য মনে করে, এটি সরাসরি পররাষ্ট্রনীতির সীমা লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারে আঘাত।
জুবায়ের বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে ভারত পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীরা। এসব খুনিদের আশ্রয় দিয়ে সরাসরি পররাষ্ট্রসীমা লঙ্ঘন করেছে ভারত। আপনারা দেখেছেন, গত ১৭ ডিসেম্বর বুধবার জুলাই ঐক্যের পক্ষ থেকে যৌক্তিক দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। আমাদের এই কর্মসূচি ছিল পূর্বঘোষিত। নির্ধারিত সময়ে আমরা রামপুরা ব্রিজ থেকে মার্চ শুরু করি। আমাদের লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ মার্চের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো ও দাবি উত্থাপন। সেই লক্ষ্যেই আমরা মিছিল নিয়ে বাড্ডা আসার পর পুলিশের বাধার সম্মুখীন হই। সেখানে আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে অবস্থান নেই। আমাদের এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা সাবেক একাধিক দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানান। আমাদের এই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ‘ঢাকায় কিছু চরমপন্থি গোষ্ঠী’র আন্দোলন বলে ঘোষণা দেয় মোদি সরকার। জুলাই ঐক্য ভারত সরকারের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। জুলাই ঐক্য মনে করে, সাবেক দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার এবং জুলাই যোদ্ধাদের ‘চরমপন্থি গোষ্ঠী’ বলে সম্বোধন করে ভারত নিজেদের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দিয়েছে।
জুবায়ের আরও বলেন, আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের চরমপন্থি ও জঙ্গি আখ্যা দিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো হতো। ভারত সেই একই কায়দায় জুলাই যোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক সাবেক সেনা অফিসারদের চরমপন্থি আখ্যা দিয়ে হত্যাযোগ্য করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকারের এসব মন্তব্য বাংলাদেশের কথিত সুশীলরা গ্রহণ করে টকশো ও বিভিন্ন পত্রিকার কলামে লেখার মাধ্যমে জুলাই ঐক্যকে জামায়াত শিবির আবার কেউ উগ্রপন্থি বলে ট্যাগ দিয়ে হত্যাযোগ্য করে তুলেছে। শুধু গণমাধ্যমই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বট বাহিনীর সদস্যরা জুলাই ঐক্যে অংশগ্রহণকারি সাধারণ ছাত্রজনতাকে জামায়াত শিবির ও উগ্রপন্থি ট্যাগ দিয়ে নানাধরণের কটূক্তি করছে। নানা ধরনের ন্যারেটিভের মাধ্যমে জুলাই যোদ্ধাদের হত্যাযোগ্য করে তুলছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ জুলাইয়ের অস্তিত্ব ও আমাদের সহযোদ্ধা শরিফ ওসমান বিন হাদি। যারাই অধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, যুগে যুগে তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে হত্যার মিশনে ভারত।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত হওয়া জুলাই ছাত্রজনতার ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সময়ে এবং পরবর্তীতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনার ভার্মা সরাসরি যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। এতে করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। ভারতীয় মিডিয়া এবং সে দেশের জনগণ জানে, ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালায় হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত উগ্র হিন্দু চরমপন্থি গোষ্ঠীরা। সে ঘটনার সুরাহ না করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া গণহত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে ভারত। অবিলম্বে এসব খুনিদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার জুলাই যোদ্ধাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে যেভাবে চরমপন্থিদের আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করেছে, তা চরম সীমালঙ্ঘন। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো জবাব চায়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আল্টিমেটাম দিয়ে জুবায়ের বলেন,দিল্লি থেকে এর জবাব চাওয়ার জন্য। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লি থেকে জবাবদিহিতা না চায়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মার্চ করবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম জুলাই ঐক্য।
দ্যা ডেল্টাগ্রামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাতে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের সময় প্রত্যাশিত কূটনৈতিক দায়িত্ববোধের মানদণ্ড ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা লঙ্ঘন করেছেন। একটি ব্যাপক নিধনযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চলাকালীন সময়ে যে সব আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত একটি শাসনব্যবস্থাকে জনপরিসরে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন, প্রণয় কুমার ভার্মাসহ যারা এমন কর্মকাণ্ড করেছেন তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে জুলাই ঐক্য। তা নাহলে জুলাই ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত একশোরও অধিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে সারাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলা হবে।
জুলাই ঐক্যের এই নেতা বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী, প্রণয় কুমার ভার্মাকে পারসোনা নন গ্রাটা ঘোষণা করতে হবে। ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মাকে পারসোনা নন গ্রাটা ঘোষণা করা হবে একটি বৈধ, আনুপাতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিক্রিয়া—যা কূটনৈতিক আস্থাহীণতার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। তাকে পারসোনা নন গ্রাটা ঘোষণা করা হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে, নৈতিক মানদণ্ড সমুন্নত থাকবে এবং এই নীতিকেই শক্তিশালী করবে যে গণহত্যার সময়ে নীরবতা বা জনসমক্ষে স্বাভাবিক হিসেবে পরিস্থিতিকে উপস্থাপন করার হীণ প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এবি জুবায়ের বলেন, আমরা বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেড়েছি ভারত লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পূনর্ভাসনের চেষ্টা করছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগকে কোনোভাবে নির্বাচনে আনা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা করছে সে সব লবিস্টরা। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বুঝানোর চেষ্টা করছে ভারত। বাংলাদেশে অবস্থিত সব রাষ্ট্রদূতদের অনুরোধ করছি, ভারতের ফাঁদে পা দিবেন না। ভারত কখনও কারও বন্দু নয়। তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। আপনারা বাংলাদেশে আছেন, আমরা চাই এদেশের সরকার এবং জনগণের পক্ষ নেওয়াই হবে আপনাদের সঠিক সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, ভারত আমাদের হত্যার হুমকি দিলেও বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে নজির স্থাপন করছে বাংলাদেশ। ভারত বন্ধু রাষ্ট্র। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সহযোগীতা মূলক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। কোন দালাল তাবেদারী নীতিতে নয়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে যতটুকু সম্মান দেবে, বাংলাদেশও ততটুকু ন্যায্যতার ভিত্তিতে দেবে। নতুন বাংলাদেশে কোনো নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এ দেশের ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। সম্পর্ক হবে ইনসাফের ভিত্তিতে।
সংভাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করেন ডাকসুর সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ওজুলাই ঐক্যের সংগঠক মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ। তিনি বলেন, সাবেক দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার এবং জুলাই যোদ্ধাসহ দেশের নাগরিকদের ভারত সরকার ‘চরমপন্থি গোষ্ঠী’ বলে যে মন্তব্য করেছে, তার প্রতিবাদে আগামী ১৯ ডিসেম্বর শুক্রবার চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট—এই তিন বিভাগে প্রতিবাদ মিছিল করবে জুলাই ঐক্য। একই সঙ্গে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভারতকে ‘চরমপন্থি গোষ্ঠী’ এই মন্তব্যের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় না আনলে আগামী ২৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মার্চ এবং স্মারকলিপি দেবে জুলাই ঐক্য।
জুলাই ঐক্যের সংগঠক ইসরাফিল ফরাজীর পরিচালনায় আরও বক্তব্য রাখেন, লে. কর্ণেল অব. হাসিনুর রহমান, জুলাই ঐক্যের সংগঠক ও ডাকসুর স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মিনহাজ।
সংবাদ সম্মেলনে উপিস্থত ছিলেন, কর্ণেল অব. আজিজ, ফাহিম ফারুকী, শাদীল আহমেদসহ জুলাই ঐক্যের সংগঠকগন।