সংবিধান সংশোধনসহ অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আলাপÑআলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করবে বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলাকালে এমন মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির দফাওয়ারি আলোচনা হচ্ছে। কমিশন স্প্রেডশিটে ‘হ্যাঁ-না’ সংক্ষিপ্ত জবাব দেওয়ার জন্য যে কাগজ দিয়েছিল, তাতে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, ‘মিসলিড’ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যেসব বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে আমরা সেটা অবশ্যই বিবেচনা করব।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে দলের পক্ষে সূচনা বক্তব্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, সংস্কার একটা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া, এটি হতেই হবে। তিনি বলেন, আমি যখন একা আমার ঘরে থাকি তখন ঘরের যে সেটআপ যখন বিয়ে করি সেটা বদলে যাবেই। আমাদের যখন সন্তান হবে তখন সেটা আবার বদলে যাবে। আরেকটা সন্তান হলে আরো বদলে যাবে, তাদের বয়স যখন বাড়বে তখন আবার বদলে যাবে। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলায়, বদলাবেই।
নজরুল ইসলাম খান এও বলেন, আমরা সবাই ভালো চাই। আরও ভালো চাই, আরও ভালো চাই। কিন্তু খুব ভালো করার জন্য যেন আমরা এতো সময় না নেই যাতে মানুষের পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা সেটা স্তিমিত হয়ে যায়। নিশ্চয় আমরা ভালো করতে চাই এবং এই ভালো করার প্রয়াস অব্যাহত থাকবে, সব সময় থাকবে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদ ভবনের এলডি হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক সংস্থাপন সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে ছিলেন, কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মনির হায়দার।
সূচনা বক্তব্যে নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা বুধবারও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপির চাইতে বেশি সংস্কার বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দল করেছে? রাজনৈতিকভাবে বলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা তো বিএনপি করেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র তো বিএনপি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক শাসন ব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকারণ তো অনেক ক্ষেত্রে করেছে। এমনকি বিএনপি তো গ্রাম সরকার প্রবর্তন করেছে। তাতে আর কতদূর পর্যন্ত আমরা প্রশস্ত করতে চাই। আপনি মুক্ত বাজার অর্থনীতি বিএনপি চালু করেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন বিএনপি গঠন করেছে। আজকে অর্থনীতির সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত হলো ভ্যাট, বিএনপি করেছে। অর্থনীতির মূল স্তম্ভ পোশাক খাত বিএনপির হাতে হয়েছে, কৃষি উন্নয়ন, প্রবাসী কর্মসংস্থান, পল্লী বিদ্যুতায়ন থেকে শুরু করে সমবায় উন্নয়ন, কুটির শিল্প, সব কিছুরই উন্নয়ন বিএনপির হাতে হয়েছে।
বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে না, বিএনপি সংস্কারের দল উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, তারপরও কেউ কেউ নানা কথা বলেন, তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করে নাই, তখন তো দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দিয়েছেন। কেউ যখন সংস্কারের কথা ভাবেনি তখন শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি এবং আমরা এটা বলেছি, এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব থাকলে সেটা সাদরে গ্রহণ করব। কাজেই যদি ঐকমত্য কমিশনের সনদ নাও হয় বিএনপির জন্য সনদ আছে একটা সংস্কারের সনদ। কাজেই আমরা সংস্কারের পক্ষে।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা একটা জিনিস বলব, সব কিছুর উপরে জনগণ। জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায় আমরা জানি। আমরা বিশ্বাস করি, এমন যোগ্য মানুষরা এই কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের নেতৃত্বে এই কমিশন কাজ করেছে। তাদের সহযোগিতায় আমরা আগামী দিনে আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, আমাদের সামনে আরেকবার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কাজে লাগাতে চাই। আমরা সেই প্রত্যাশা নিয়েই এই কমিশনকে সহযোগিতা করছি এবং এই সরকারকে সহযোগিতা করছি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলের সাথে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস সভাপতিত্ব করেন। এরপর থেকে সংসদ ভবনের এলডি হলে আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশন সদস্যরা আলাদা আলাদাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করছে। সংস্কার কমিশনগুলোর করা সুপারিশ চূড়ান্ত করতে গত ২০ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম বৈঠকটি হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি(এলডিপি) সাথে। এই পর্যন্ত তারা ১১ টি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক শেষ করেছে।
সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চায় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশগুলো স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। গত ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছিল। মতামতের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করেছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করবে ঐকমত্য কমিশন আর এর ভিত্তিতেই হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির দফাওয়ারি আলোচনা হচ্ছে। কমিশন স্প্রেডশিটে ‘হ্যাঁ-না’ সংক্ষিপ্ত জবাব দেওয়ার জন্য যে কাগজ দিয়েছিল, তাতে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, ‘মিসলিড’ করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে ৭০টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করবেন তারা। সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করবেন এক জায়গায় আসার জন্য।
সালাহ উদ্দিন আহমদ জানান, বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের ২৫টি প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত। বাকি বিষয়গুলোতে একমত হতে পারেনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আমরা যেসব বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে আমরা সেটা অবশ্যই বিবেচনা করব।
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধান সংস্কার দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারপর বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে। আজ আলোচনা শেষ না হলে পরেও আলোচনা হবে। তারা বোঝাতে চান, বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে কতটা ‘সিরিয়াস’।
সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা যেসব বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সেসব বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব।
বিচার বিভাগের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনে ‘মিসলিড’ করা হয়েছ দাবি করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিস্তারিত প্রতিবেদনের ১৫০টি মতামতের মধ্যে ৮৯টির বিষয়ে মতামত দিয়েছি, বাকিগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হওয়া বা মন্তব্যসহ একমত হওয়ার কথা জানিয়েছি।
হ্যাঁ/না-তে মতামত চাওয়া বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনে বিস্তর ফারাক আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের সংশোধনী ব্যতিরেকে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা ততক্ষণ পর্যন্ত অসাংবিধানিক হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংবিধানে গৃহীত হচ্ছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘন সমুচিত হবে না।
বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রক্রিয়া যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়। সেজন্য বিস্তারিত মতামত দেব। লিখিতও দিয়েছি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বিষয় সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত দাবি করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে তারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা বজায় থাকবে না।
বিএনপির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা দ্বিতীয় পর্যায়ের জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে আরও আলোচনা হবে। কারণ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, এ দেশে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে না হয় সেজন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সংগ্রাম করেছে। এক্ষেত্রে বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা। যাতে করে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।