ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলের ভরাডুবিকে কেউ কেউ দীর্ঘদিন পর ভোট হওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দিলেও হতভম্ব বিএনপির হাইকমান্ড। দলটির নেতাকর্মীরা এমন শোচনীয় পরাজয়ের চিন্তাও করেনি। কারচুপি, কোন্দল, দীর্ঘদিন ভোট বন্ধ থাকাকে কারণ বললেও মূলত দেশব্যাপী বিএনপি ও অঙ্গদলের সার্বিক কার্যক্রমকে দায়ী করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তারা বলছেন, নির্বাচনে প্রতিপক্ষের কাছে ধরাশয়ী হওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে ৫ আগস্ট পরবর্তী কার্যক্রম। এছাড়া নির্বাচনে জয়লাভের মতো কোনো কৌশলই ছিলো না বিএনপির। দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই নির্বাচন ইস্যুতে খামখেয়ালি মনোভাবে ছিলেন। তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ^াস ছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের ভোট দিয়ে দিবে।
গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শীর্ষ তিন পদসহ ৯টি সম্পাদকীয় ও সদস্য পদের অধিকাংশতেই বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। তিনটি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হলেও কোন পদেই ছাত্রদল প্যানেলের নেতারা জয়লাভ করতে পারেনি। অন্যদিকে ভোটের ব্যবধানও ছিলো অনেক।
জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দেশের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে বিবেচিত ডাকসু নির্বাচনে অভাবনীয় পরাজয়কে খুব সিরিয়াস হিসেবে নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। মুখে তেমন কিছু না বললেও পর্দার অন্তরালে পরাজয়ের কারন খুঁজছেন। তবে জাতীয় নির্বাচন ব্যহত হয় কিংবা বাধাগ্রস্ত হয় এমন আশঙ্কায় প্রকাশ্যে কোন কিছু বলতে নারাজ দলটি। বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, ডাকসু নির্বাচনের জন্য দল মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ৫ আগস্ট পরবর্তি সারাদেশে চলমান কার্যক্রমে নানা মহলে সমালোচনার র্শীষে ছিল তারা। ঢাবির দল সমর্থিত শিক্ষকরাও এই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
ছাত্রদল নেতাকর্মীরা বলেছেন, ছাত্র শিবির দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় সাধারণ শিক্ষার্থীসহ নারী ভোটারদের মনজয় করতে কাজ করেছেন। বিভিন্ন সেক্টরে আলাদা আলাদা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন ওই সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের স্টেক হোল্ডার হিসেবে নিজেদেরকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবস্থান সুসংহত করতেও সক্ষম হয়েছে এ সংগঠনটি। পক্ষান্তরে ছাত্রদলের কোন পরিকল্পনাই ছিলো না। নিজেদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিলো না। শিক্ষক, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গেও কোন আলাদা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে নাই। এর সঙ্গে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভরাডুবি ঘটিয়েছে। এছাড়া জামায়াত-শিবির ইস্যুতে পুরনো ইতিহাস নিয়ে সমালোচনা, শিবিরকে নিয়ে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য, ক্যাম্পাসে শিক্ষাবান্ধব কাজের নজির না থাকার কারণে এর প্রভাব নির্বাচনে পড়েছে।
দলটির নেতাকর্মীরা জানান, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও ছাত্রদল ছিলো নির্বিকার। নির্বাচনী তপসিল ঘোষণার পর তোড়জোর শুরু করে প্যানেল গঠন করেন দায়িত্বশীল নেতারা। অল্প সময়ে প্যানেল গঠন করায় বিভিন্ন গ্রুপকে এক প্লাটফর্মে আনতে পারেনি সংগঠনটি। সবাই যখন প্যানেল ঘোষণা করছে তখনো ছাত্রদল প্যানেল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের জন্যই একদিন প্যানেল জমা দেয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। কারা নির্বাচন করবেন এই নিয়ে দলের মধ্যে নানা মত ও বক্তব্যের প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। আবার এই নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দলের প্রত্যেক স্তরের নেতাকর্মী আর সমর্থকদের পাশে টানতেও পারেনি। শুধুমাত্র প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজ ও দলের নাম দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছে সংগঠনটি। শিক্ষক, নারী ভোটার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ তেমন ছিল না বললেই চলে।
সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও ডুবিয়েছে সংগঠনকে। ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারাসহ বিএনপির দায়িত্বশীলরা মনে করেছিলো- ঢাবিতে সবচেয়ে মেধাবী আর সচেতন শিক্ষার্থী। এরা কখনোই একটি ইসলামী সংগঠনকে সমর্থন দেবে না। ছাত্র শিবিরের নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংকের বাইরে তারা ভোট পাবে না বলে অঙ্ক কষেছিলো। কিন্তু তা বুমেরাং হয়েছে। শিবির গত দেড় দশকে তাদের উপর যে অত্যাচার নির্যাতন করেছিল তার প্রচার করতে পেরেছে। এছাড়া গত এক বছর তারা শিক্ষাবান্ধব কাজ করেছে। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাসহ ক্যাম্পাসের মান উন্নয়নে কাজ করেছে। বিপরীতে ছাত্রদল মিছিল মিটিং বা শোডাউন ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। এগুলো শিক্ষার্থীরা বিবেচনায় নিয়েছে বলে মনে করে বিএনপির হাইকমান্ড। ।
ডাকসু নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য ছাত্রদলের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন অনেকেই। তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক ছাত্রনেতা-কর্মী, সমর্থকদের মধ্যে কোন সমন্বয় গড়ে তুলতে পারেনি সংগঠনটি। বিক্ষিপ্তভাবে আর জোড়াতালি দিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা হয়েছে। যে যার গ্রুপের নেতাকে জয়ী করতে কাজ করেছেন। কিন্তু সমন্বিত প্যানেলকে জেতাতে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। এছাড়া ঢাবির বড় একটা অংশই প্যানেলে থাকা প্রার্থীদের পক্ষে সেভাবে কাজ করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সেট আপ ছিল নির্বাচনের প্রতিকূলে। ফলে বিরোধীরা নির্বাচনে একচেটিয়া সুবিধা পেয়েছে। ভোটে নানা অভিযোগ দেয়া হলেও সেগুলো আমলে নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ভোটের হার যেটা দেখানো হয়েছে সেটা কল্পনাও করা যায় না।
নেতাকর্মীরা জানান, ঢাবিতে বিএনপিপন্থি সাদা দলের শিক্ষকদের কাজে লাগাতে পারেনি ছাত্রদল। নির্বাচনের আগে ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। সেখানে সাদা দলের শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। প্যানেল ঘোষণার আগেও শিক্ষকদের মতামত নেওয়া হয়নি। তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনায় শিক্ষকরা ছাত্রদলের পাশে সেভাবে এগিয়ে আসেন নি।
পর্যবেক্ষকরা ছাত্রদলের ভরাডুবির পেছনে যেটিকে বেশি প্রাধাণ্য দিচ্ছেন সেটি হচ্ছে, ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের শিক্ষাবান্ধব কার্যক্রমের অভাব। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন যেভাবে ক্যাম্পাসে কাজ করেছে তার ধারেকাছেও ছিলনা ছাত্রদল। উল্টো তারা প্রতিনিয়তই প্রতিপক্ষকে নিয়ে মিথ্যাচার করে গেছে। যা শিক্ষার্থীরা ইতিবাচকভাবে নেয়নি। জুলাই আগষ্ট পরবর্তি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ধারাবাহিক অনুপস্থিতি, শিক্ষার্থী বান্ধব কর্মসূচি না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে পায়নি সংগঠনটি। নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্রদলের যে সকল নেতাকর্মী নিজস্ব উদ্যোগে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করেছিলো তাদেরকেও কেন্দ্র থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক সালেহ মো. আদনান বলেন, বিগত দিনে ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগের তীব্র আক্রমন, হামলা-মামলা আর শিক্ষা জীবন শেষে কর্মজীবন নিয়ে নির্ঘাত অনিশ্চয়তায় থাকায় অনেকেই সেভাবে কাজ করতে পারেনি। পক্ষান্তরে শিবির তার নিজস্ব কৌশলে খুব ভালো ফলাফল করেছে। আবার গণঅভ্যুত্থানের পরে ছাত্রদল যখন ক্যাম্পাসে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করে তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটিকে ভালো ভাবে নেয়নি। যার কারনে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ে। এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় ছাত্রশিবির।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণা নির্বাচনের বিরুপ প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীরা হলে প্রকাশ্যে ছাত্র রাজনীতির বিরোধীতা করে আসছিল। এটিকে উপেক্ষা করে ছাত্রদল কমিটি ঘোষণা করে। যার প্রভাব পড়ে নির্বাচনে। এছাড়া নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ঘোষিত হল কমিটি নিয়ে সংগঠনের মধ্যেই তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বিতর্কিত এই কমিটি হল নির্বাচনে শক্ত কোন অবস্থানই তৈরী করতে পারেনি। কমিটি গঠনের পর ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততায় অনেককেই বহিস্কার করা হয়। শিক্ষার্থীদের নিষেধ সত্ত্বেও হল কমিটির করায় এর প্রভাব পড়ে ডাকসু নির্বাচনে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম বকুল বলেন, আমরা নির্বাচনের সকল ডাটা সংগ্রহ করছি। এরপর নিজেরা বিশ্লেষণ করে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রাখতে পারবো। এর আগে কোন কথা বলতে চাই না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন পর নির্বাচন হওয়া ডাকসুতে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছে ভোটের ফলাফলে। তিনি বলেন, দল ডাকসু নিয়ে আলোচনা করবে, কেন এমন হলো। সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করবো।