শেখ হাসিনার পতনের ছয় মাস পর হটাৎ কেনো আবার উত্তাল? পাশাপাশি শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর বাড়িসহ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের বাড়িতেও আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা ।
ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনা বুধবার সন্ধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি উত্তপ্ত ভাষণ দেয়ার পরই ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে জড়ো হয় জনতা। বক্তৃতায় হাসিনা তার সমর্থকদের নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আহ্বান জানান।
জুলাই-আগস্টে হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতেও হামলা চালানো হয়। এর মাধ্যমে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটানো হয়। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। সেসময় ছাত্রদের দমন করতে দেশব্যাপী সহিংসতার পথ বেছে নেয়া হয়েছিল। যার ফলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং তাতে অন্তত ৮৩৪ জন নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা ব্যাতীত শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের সকল সদস্যকে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে এক সামরিক অভ্যুত্থানের সময় হত্যা করা হয়। সেই সময় হাসিনা এবং তার বোন রেহানা জার্মানিতে ছিলেন। তারা ভারতে আশ্রয় নেন এবং ১৯৮১ সালের মে মাসে হাসিনার বাংলাদেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। ফিরে আসার পর হাসিনা ১৯৮১ সালের ১০ জুন দেশের স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেন। যা ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট উদ্বোধন করা হয়।
১৯৯০ সালের মধ্যে দেশে ৪টি সেনা শাসন বা সেনা-সমর্থিত সরকারের ধারাবাহিকতার পর ওই বছর প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিন অনুষ্ঠিত হয়। পরে বেগম খালেদা জিয়ার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে পরাজিত করে প্রথম ক্ষমতায় আসে হাসিনার আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই বাড়িটির তাৎপর্য ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শেখ মুজিবকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত বিশ্বের বহু নেতাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে এসেছিলেন।
৩২ নম্বরে সাম্প্রতিক হামলার কারণ কী?
শেখ মুজিবের বাড়ি এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ সদস্যদের সম্পত্তিকে বছরের পর বছর ধরে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি এবং বিরোধী কণ্ঠ দমনের আইকন হিসেবে দেখে বিক্ষোভকারীরা। গত বছর হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ভেঙে ফেলার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারণা জোরদার করা হয়।
গত মঙ্গলবার বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে বুধবার রাতে একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। ভারতে থেকে হাসিনার এভাবে প্রচারণা চালানোয় গত বছর ভারতকে হুঁশিয়ার করেন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র নেতারা।
দিল্লির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তারা বলেছিলেন, ভারত থেকে হাসিনাকে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে ‘বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে ছাত্র সংগঠনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, আজ রাতে ফ্যাসিবাদের আস্তানা থেকে মুক্ত হবে বাংলাদেশ। প্রতিক্রিয়ায় ধানমন্ডি ৩২ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে পুলিশ।
হাসিনার পারিবারিক বাড়িটির কী হয়েছে?
বুধবার সন্ধ্যার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে জড়ো হন বিক্ষোভকারীরা। নিরাপত্তা জোরদার করতে সেনাবাহিনীর একটি দল পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য যোগ দেয় তবে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বাকবিতণ্ডার পর তারা সেখান থেকে সরে যায়। এরপর আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ এবং এক্সে নিজের লাইভ বক্তৃতায় অন্তর্বর্তী সরকারকে বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ করেন হাসিনা। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
এতে ক্ষোভে ফেনে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রজনতা। তারা লাঠি, হাতুড়ি এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ৩২ নম্বর বাড়িটিতে ভাঙচুর চালান এবং আগুন ধরিয়ে দেন। এর পাশাপাশি অন্য কেউ ভবনটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ক্রেন এবং বুলডুজার নিয়ে আসেন। এরপর বুলডুজার দিয়ে যখন বাড়িটি ভাঙা শুরু হয় তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন বিক্ষোভকারীরা।
তারা স্লোগান দিতে থাকেন- ‘ফ্যাসিবাদের আস্তানা ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও। দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা। আবু সাঈদের বাংলায় হিন্দুত্ববাদের ঠাঁই নাই। আবু সাঈদ ছিলেন হাসিনা বিরোধী শক্তি যাকে গত জুলাই অভ্যুত্থানে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। আর হিন্দুত্ববাদ হচ্ছে- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ মতাদর্শ।
এই ঘটনার পর আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কী?
একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ, যা এখন ব্যাপক প্রতিকূলতার মুখোমুখি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি ভাঙার ঘটনাটি জনগণের একটি অংশের ঐতিহ্যের প্রতি তীব্র প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে গত বছরের গণবিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি।
সূত্র: আল জাজিরা থেকে নেওয়া