মানুষের আকাক্সক্ষা, কষ্ট ও চাহিদার জায়গাগুলো বুঝতে না পারলে সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। গতকাল শনিবার বিকেলে এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তারা এ আশংকা প্রকাশ করেন। দৈনিক প্রথম আলো ‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শিরোনামে এ বৈঠকের আয়োজন করে। দৈনিকটির সম্পাদক মতিউর রহমানের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। সঞ্চালনা করেছেন নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে একটি বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা চলছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে। কিন্তু মানুষের আকাক্সক্ষা, কষ্ট ও চাহিদার জায়গাগুলো বুঝতে হবে। এসব অনিশ্চয়তার অবসান না হলে সংকট আরও বাড়বে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা মতপার্থক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বার্থে ঐকমত্য কমিশন যে দীর্ঘ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন সংযোজন হলো এই যে আমরা একসঙ্গে সমাধানগুলো খুঁজেছি। তিনি বলেন, অনিশ্চয়তার কারণেই কিন্তু অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং জীবিকায় একধরনের দীর্ঘমেয়াদি খাদ তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়গুলোতে একটা তাগাদা তৈরি করা প্রয়োজন। অঙ্গীকার নিয়ে এত কথা হচ্ছে কিন্তু দুর্নীতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কেন একটা অঙ্গীকারের প্রস্তাব তৈরি করল না, সেই প্রশ্ন তোলেন হোসেন জিল্লুর। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে তো এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা সুস্পষ্ট করা যেত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার প্রশ্নে হতাশাবাদীরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন উল্লেখ করে বলেন, রাজনীতির নিয়ম হলো যতটুকু সম্ভব, ততটুকু করতে হবে। বাকিটার ক্ষেত্রে আকাক্সক্ষা থাকতে পারে। এই বাস্তববাদিতা থাকা দরকার। তিনি বলেন, সংবিধানে কোনো কিছু লিখে দিলেই তাতে কাজ হয় না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল। বিচারিক প্রক্রিয়া ও কলমের খোঁচায় তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, সংবিধানের বিভিন্ন জিনিস সংস্কারটা প্রয়োজনীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পর্যাপ্ত শর্ত হলো জনমানুষের অংশগ্রহণ, নাগরিকদের কাছে জবাবদিহির জায়গাটাকে সোচ্চার করা এবং রাজনীতি, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, ব্যক্তি খাতÑ ইত্যাদি সবাই সোচ্চার থাকা।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে যদি একমত না হওয়া যায়, তাহলে আমার শঙ্কা হচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা যে জায়গায় দাঁড়াব, তাতে মৌলিক কোনো হেরফের ঘটবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমি বারবার আহ্বান করেছি। তারা যথেষ্ট পরিমাণে সাড়া দিয়েছে, কিন্তু কোনো না কোনো সময় তো প্রক্রিয়াটা শেষ করতে হবে, এটা তো অনিঃশেষ প্রক্রিয়া হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনটা করতে হবে
আলী রীয়াজ বলেন, আগামী নির্বাচনটি আমরা করছি এ কারণে যে রাষ্ট্র কাঠামোর ক্ষেত্রে কতগুলো পরিবর্তন আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সংস্কার কমিশনে কাজ করার সময় আমরা দেখেছি, গত ১৬ বছরের যে সংকট, সেটা ১৬ বছরের সংকট নয়। ১৬ বছরের সংকটের ভয়াবহতাটা আমরা দেখতে পেয়েছি; কারণ একটা ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে আমরা বিভিন্নভাবে এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি।
শুধু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে নির্বাচন হলে তা দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে পারবে না বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন আয়োজন করব এবং পরে দেশটা কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা যদি আমরা এখন ঠিক করতে না পারি, তাহলে সেই নির্বাচন আমাদেরকে কাঙ্ক্ষিত সফলতা দেবে না। আমাদের কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জায়গাতে আমাদেরকে পৌঁছে দেবে না। তিনি বলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে ১৪-তে, ১৮তে, ২৪-এ আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে, সেটা তো আমাদের এখানে গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে পারে নাই। তিনি বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো সংশয় আমাদের কারো নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যেই এখন পর্যন্ত এই ধরনের বক্তব্য নেই যে, নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অনেকগুলো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। এখন এগুলো বাস্তবায়নের বিষয়। এখন বলটা বহুলাংশে আমাদের রাজনৈতিক দলের কোর্টে। দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে যে কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়িত হবে। একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে সরকারকেও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। অতীতের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের ঠিক করতে হবে। শেখ হাসিনা বিদ্যমান নিয়মনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেই কাজে লাগিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনার পক্ষে এটা সম্ভব ছিল, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন। এগুলো করেই এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যার পরিণতিতে শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে। এখন এ বিষয়গুলো যদি আমরা মেরামত না করি, বিদ্যমান পদ্ধতি-প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি আমরা পরিবর্তন না আনি, তাহলে আমাদের আগে যা ঘটেছে, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপের ফলে একটি অনির্বাচিত সরকার সহজে নমনীয় হয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান। তার মতে, যত তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচিত সরকার আসবে, ততই ভালো। একটা অনির্বাচিত সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপের দ্বারা সহজে নমনীয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসে হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন যদি না হয়, আবার আমাদের সবাইকে আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থায় যেতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে যারা জিতেছেন, তারা দলীয় পরিচয় নিয়ে জিতেছেন কি না, জানি না। তবে যারা হেরে গেছেন, তারা দলীয় পরিচয় নিয়ে নির্বাচন করেছেন। জাকসু নির্বাচনেও ২৫টি পদের মধ্যে ২১টিতে বিজয় লাভ করল একটি সংগঠন। এখানে প্রায় ৬০ হাজার ছাত্রের মতামতের প্রতিফলন হয়েছে। সুতরাং আমরা কি এখনো বসে থাকব? প্রত্যেকটি জরিপে তিন মাস আগে এক রকম ছিল, এখন আরেক রকম। ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য যখন জনগণের কাছে যাবে, আরেকটু হবে। এ জন্য আমি বলছি, মেহেরবানি করে প্লিজ কাম, আমরা একটা পয়েন্টে আসি।
সংস্কার বাস্তবায়ন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে গো ধরে না থাকার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমাদের অতীতের সব গো ধরা কিছুকে বাদ দিয়ে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়ে, অবশ্যই রেফারেন্ডমের আয়োজন করার অতীত রেফারেন্স আছে, সেটার ভিত্তিতে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জুলাই সনদকে সাংবিধানিক এবং আইনি ভিত্তি দিয়ে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তাহলে দেশ বাঁচবে, রাজনীতি বাঁচবে এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা বাঁচবেন।
রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া অতীতে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি উল্লেখ করে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ১৯৯১ সালে আমরা সবাই রাজনৈতিকভাবে একমত হয়েছিলাম। কিন্তু যে ব্যবস্থার ব্যাপারে একমত হয়েছিলাম, সেটা আমরা ইন্ট্রোডিউস করতে পারিনি। ওই সময় জনগণের ঐকমত্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যদি সেটা প্রথমেই ইন্ট্রোডিউস করে নেওয়া যেত, তাহলে আর এই সংকটটা আসত না। আমি মনে করি, আমরা রাজনীতিবিদরা জনগণের বিশ্বাস হারিয়েছি। কারণ রাজনীতিবদরা যা বলেন, তা করেন না। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে তাঁরা এক বক্তব্য দেন, আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর আরেক। আজকে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। এই জোর করে থাকার প্রবণতা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, তার ভুক্তভোগী বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক নেতা ও দল।
রাজনৈতিক নেতাদের সচেতন থাকতে হবে উল্লেখ করে গোলটেবিল বৈঠকে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জনগণের প্রতিশোধ কিন্তু নির্মম, ২০২৪ সালে জনগণ নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছে। যিনি গর্ব করতেন ‘আই এম ডটার অব দ্য ফাদার অব দ্য নেশন’, এই দেশ তিনি ছাড়বেন না, তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫, ৫৬, ৫৮, ৫৮, ৫৯ এবং ৬৫ থেকে ৯২ পর্যন্ত সব ধারা অকার্যকর হয়ে গেছে। সুতরাং সংবিধান তো অকার্যকর হয়েই গেছে। এই অবস্থায় ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি ও জনগণের অভিব্যক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এই নেতা বলেন, এখন আমরা একটা নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছি যে কী পদ্ধতিতে সংস্কার বাস্তবায়ন হবে। এই পদ্ধতির বহু দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে আছে। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতারা যদি দলীয় স্বার্থে অথবা আগামী দিনে ক্ষমতায় এলে কোন কোন ধারা অবলম্বন করব, সেটাকে বিবেচনায় রাখি, সমস্যার কোনো দিন সমাধান হবে না। জাতির জন্য প্রয়োজন কোনটি, সেটাকে আমাদের সামনে রাখতে হবে। স্বৈরাচার তৈরি করে বিদ্যমান ব্যবস্থা। তাই এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আমি মনে করি, যাদের ওপর ক্ষমা অর্পিত হয় তাদের জাতির ক্রান্তিলগ্নে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়।
মতিউর রহমান আকন্দ আরও বলেন, আমি মনে করি, নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসে হতেই হবে। কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন যদি না হয়, আবার আমাদের সবাইকে আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থায় যেতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই দেশ আমাদের। এই দেশের জনগণ আমাদের ম্যান্ডেট দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে দায়িত্ব দিয়েছে। হেজিটেশন কীসের? যদি বারবার আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে হয়, বারবার করতে থাকব। কিন্তু একটি ছিদ্রপথের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার অভিপ্রায় যেন আমাদের এই দেশের সবকিছুকে ধ্বংস কারণ না হয়, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সব রাজনৈতিক দলকে জনগণের সেন্টিমেন্ট দেখা উচিত।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।