সংখ্যানুপাতিক হারে ভোটের নামে দেশে জগাখিচুড়ি চলছে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল শনিবার দুপুরে এক আলোচনা সভায় কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবির প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন একটা জগাখিচুরি ঘটনা চলছে। কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল তারা বিভিন্ন রকম কথা বলতে শুরু করেছেন এবং যে বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্কই নেই। যেমন আপনি দেখুন খুব জোর করে বলছে, জোর গলায় বলছে যে, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন। অর্থাৎ আনুপাতিক হারে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন। আমাদের সাধারণ মানুষ তো বুঝেই না, আনুপাতিক হারে নির্বাচনটা কী? তারা (জনগণ) জানে, একজন প্রার্থী দেবে পার্টি, সেই প্রার্থীর যেই মার্কাই হোক ধানের শীষ অথবা দাঁড়িপাল্লা অথবা কুলা পাতা যাই হোক, সেখানে গিয়ে সে ভোটের দিন ভোট দেবে, ভোট দিয়ে নির্বাচন করবে। এখন ইনারা বলতে শুরু করেছেন আনুপাতিক হারে নির্বাচন হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আনুপাতিকটা কী জিনিস? সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন তারা বলতে পারবে না। আমরা যারা রাজনীতি করি কিছুটা বুঝার চেষ্টা করি, তাতে করে ভোট হবে, জনগণ ভোট দেবে, যে দলটি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে তারা তাদের নমিনেশন দেবে পার্লামেন্টে যাওয়ার জন্য। এতে করে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যারা তাদের এলাকায় একজন নেতা চায়, প্রতিনিধি চায় তাদের কাজগুলো করার জন্য একজন নেতৃত্ব খুঁজে সেটা কোনো মতেই এই পদ্ধতিতে সম্ভব হবে না। আমরা এই কারণেই বলেছি যে, নি¤œ কক্ষের যে পার্লামেন্ট সেই পার্লামেন্টে আমরা আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কথা চিন্তা করি না।
নির্বাচন বিএনপি কেনো চায়? তার ব্যাখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এখন আমরা নির্বাচন করতে গেলেই বলবে, বিএনপি শুধু নির্বাচন চায়। নির্বাচন কেনো চাই সে দিকটা কেউ ভালো করে চিন্তা করার অবকাশ পায় না। নির্বাচন না হলে আমি প্রতিনিধি নির্বাচন করবো কী করে? আর প্রতিনিধি নির্বাচিত না হলে সে পার্লামেন্টে যাবে কী করে? আর পার্লামেন্টে না গেলে জনগণের শাসনটা প্রতিষ্ঠিত হবে কোত্থেকে? কয়েকজন ব্যাক্তিকে দেশ-বিদেশ থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসে কী দেশ চালানো যায়? যায় না। এই যে সহজ সরল কথা আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে।
জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জিয়া পরিষদের উদ্যোগে ‘ফ্যাসিস্ট খুনী হাসিনার পতন ও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে বর্ষপূর্তি’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। অনুষ্ঠানে তার সুস্থতা কামনায় দোয়া করা হয়।
২০১৬ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এর মাধ্যমে সংস্কার কর্মসূচি এবং ২০২২ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফার রাষ্ট্র কাঠামোর আমুল সংস্কার কর্মসূচি তুলে ধরে ফখরুল বলেন, এখন এটা রাতারাতি সম্ভব না। অনেকে বলছেন, যে ক’জন লোক সংস্কার যারা করছেন তারা কতগুলো বৈঠক করে সংস্কারের কতগুলো বিষয় নিয়ে এসে জনগণকে এগিয়ে দিলেন আর সংস্কার হয়ে গেলো সেইভাবে সংস্কার হয় না। সংস্কার হতে হবে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, ইটস এ কনটিনিউয়াস প্রসেস। আপনি চাইলেন আর কালকে পুলিশ ঘুষ খাওয়া বন্ধ করে দেবে এটা মনে করার কোনো কারণ নাই। কাঠামোটা তৈরি করতে হবে এমনভাবে যাতে করে সে ঘুষ না খায়।
নেগেটিভ ব্যুরোক্রেসি বদলাতে হবে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ঠিক একইভাবে আমাদের যে আমলাতন্ত্র এই আমলাতন্ত্র এটা আমাদের উন্নয়নের পথে একটা বড় বাধা..ইটস এ নেগেটিভ ব্যুরোক্রেসি। এই নেগেটিভ ব্যুরোক্রেসিকে পজেটিভ ব্যুরোক্রেসি করতে হলে তার জন্য যা যা করা দরকার অর্থাৎ মূল কাজ হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সেই বিষয়গুলো করতে হবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কাছে চলে যাওয়া জনগণের কাছ থেকে তাদের কী প্রয়োজন তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটাকে নিয়ে এসে দেশ পরিচালনা করার ব্যবস্থা করা।
দেশে ক্রান্তিকাল চলছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আজ গোটা জাতি একটা ক্রান্তিকালে পৌঁছেছে। এখন আমরা অপেক্ষা করছি ট্রান্সজিশনাল পিরিয়ড গণতন্ত্র উত্তরণের একটা পথ খুঁজছি আমরা। একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম আমাদের বাংলাদেশের স্বনাম ধন্য অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানতার একটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশে যে একটা ভয়াবহ সংকট উপস্থিত হয়েছে, আমরা যে এখন একটা রাজনৈতিক শূণ্যতা এবং অর্থনৈতিক বিরুপ একটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো যেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে তাকে নিরুপন করার ব্যাপারটা। আসলে আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিস্ট শক্তি তারা যে ক্ষতিটা বাংলাদেশের করে দিয়ে গেছে সেই ক্ষতিটা পুরণ এতো সহজে হবে না। তারা সমস্ত প্রতিষ্ঠাগুলোকে ধবংস করেছে। শুধুমাত্র বিচার বিভাগ, প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু ধবংস করেনি। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।
জিয়া পরিষদের নেতৃবৃন্দকে জিয়াউর রহমানের জীবন-কর্মের ওপর গবেষণা করে তা জনগণের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
জিয়া পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় জিয়া পরিষদের অধ্যাপক এমতাজ হোসেন, অধ্যাপক মজিবুর রহমান হাওলাদার, আবদুল্লাহ হিল মাসুদ, খন্দোকার শফিকুল হাসান, আলী নূর রহমান, এম জাহীর আলী, মনোয়ার হোসেন এনাম, রুহুল আলম প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।
বই এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান : এদিকে শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের লেখা বই ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা : যাপিত জীবনের আলেখ্য’- এর প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আগে ১ লাখ টাকা ঘুষ নিলে এখন ৫ লাখ নিচ্ছে। তিনি বলেন, একজন বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেছেন আগে ঘুষ দিতাম এক লাখ টাকা, এখন দিতে হচ্ছে ৫ লাখ টাকা। আমি জানি না, বিষয়টা কীভাবে দেখবেন আপনারা। কিন্তু এটাই সত্য।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখনো পুলিশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং তারা আরও সুযোগ নিচ্ছে। কেউ তাদের কাছে সেবার জন্য গেলে তারা একবার বলে মন্ত্রণালয়ে যাও, আরেকবার বলে কোর্টে যাও। এভাবে পুলিশ তার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ তাদের তো সেই কনফিডেন্স নেই। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার মতো আস্থা নেই। কারণ বিগত সরকারের সব অকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা। ফলে বিষয়টি এত সহজ নয় যে, রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলতে পারব।
তিনি বলেন, কোনো কিছুকে চাপিয়ে দিয়ে করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রকে তার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলতে দিতে হবে। এজন্য কোনো রকম বিলম্ব না করে অতি দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়ে সংস্কার করতে হবে। সেই সংসদের জবাবদিহিতা থাকবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা খুব ভালো করে উপলব্ধি করি বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন দরকার। অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। তবে, এটা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নির্বাচনের কথা তো আমরা বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিশ্বাস করি বলে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে গিয়ে সংস্কার করতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ সামনে বড় বিপদে ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সামনে অনেক বড় বিপদ আছে, ট্যারিফ অনেক বড় বিপদে ফেলতে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে এটা আমরা বুঝতে পারি। তবে, এটা বলতে পারি দেশের অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক দল সবসময় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।