চৌগাছা (যশোর) সংবাদদাতা : আসছে ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সারা দেশের মত জাতীয় সংসদের-৮৬ ও যশোর-২ চৌগাছা-ঝিকরগাছা আসনেও শুরু হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা। দুই উপজেলা মিলে এ আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৩৭২ জন। এর মধ্যে চৌগাছা উপজেলায় ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬ হাজার ৪৬৩ জন। ঝিকরগাছা উপজেলায় ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৭১ হাজার ৯০৯ জন।
আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সাম্ভব্য প্রার্থীরা। তবে প্রার্থী ঘোষণায় এগিয়ে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত প্রায় চার মাস পূর্বে ডা. মোসলেহ উদ্দিন ফরিদকে তাদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এখনো প্রার্থী হিসেবে কারো নাম ঘোষণা করেনি। তবে দলীয় মনোনয়ন পেতে বেশ কয়েকবছর যাবৎ মাঠে ময়দানে কাজ করে যাচ্ছেন বিএনপির তিনজন নেতা। যারা মনোনয়ন পেতে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে আছেন মো. মিজানুর রহমান খান। তিনি যশোর চেম্বারস এন্ড কমার্সের সভাপতি। তিনি বেশ কয়েকবছর ধরে চৌগাছা ঝিকরগাছা উপজেলায় গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি এমএ সালাম এবং তার গ্রুপের লোকজন মিজানুর রহমান খানকে প্রচারণায় সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এলাকার নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে তিনি সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন উৎসব ও পূজা পার্বনে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করলে জানাযা ও দোয়ার অনুষ্ঠানে সময় দেন। তবে মিজানুর রহমান খান চৌগাছা অথবা ঝিকরগাছা উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ায় অনেক নেতা-কর্মী তাকে অপছন্দ করে থাকেন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি পদে নির্বাচন করে পরাজিত হলে কিছুটা ইমেজ সংকটে পড়েন। তবে সবমিলিয়ে তিনি মনোনয়ন পেতে জোর প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে কে এলাকার আর কে অন্য এলাকার এমন কোন কথা নেই, যিনি জনগণের পাশে থাকবে তাকেই জনগণ ভোট দিবে। তিনি বলেন, আমি আশাকরি দল আমাকে মনোনয়ন দিবে, কেননা আমি দীর্ঘদিন যাবৎ চৌগাছা ঝিকরগাছার মানুষের সাথে মিলেমিশে দলীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখে আসছি।
বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন পেতে আরো যারা চেষ্টা করছেন তাদের মধ্যে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি এবং সাবেক ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান সাবেরা নাজমুল মুন্নি। মুন্নীর স্বামী নাজমুল হুসাইন ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির একজন তুখোড় নেতা ছিলেন। তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হলে স্ত্রী মুন্নী রাজনীতিতে যোগ দেন। যোগদানের অল্প কিছু দিনের মধ্যে তিনি ঝিকরগাছার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তিনি উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ আমলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়ে এলাকায় সাড়া ফেলে দেন। কয়েক মাসের মধ্যে দলীয় নেতাকর্মীরা তার গ্রীপে চলে আসেন। এরপর থেকে মুন্নী স্বপ্ন দেখতে থাকেন সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে। চৌগাছা ঝিকরগাছা উপজেলার গ্রামে গঞ্জে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে গড়ে তোলেন সখ্যতা। বিপদে-আপদে কর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। ঈদ কুরবানিতে নেতাকর্মীদের খুশি করেন সাধ্যমত। প্রার্থীতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দল আমাকে মনোনয়ন দিবে, কেননা ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে আমি চরমভাবে নির্যাতন নিপিড়নের শিকার হয়েও দলের হাল ছাড়ি নাই। আমি আশাকরি দল আমার ত্যাগের মূল্যায়ন করবে।
এদিকে সাম্প্রতিক কালে সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যাপক গণসংযোগ করে যাচ্ছেন চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান যশোর জেলা কমিটির সদস্য জহুরুল ইসলাম। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। চৌগাছা ঝিকরগাছা উপজেলায় তার মত এত দীর্ঘদিন যাবৎ দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকা আর কোন নেতা নেই। বিশেষ করে চৌগাছা উপজেলার মাটি ও মানুষের রক্তের সাথে মিশে আছে জহুরুল ইসলামের নাম। উপজেলার এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে জহুরুল ইসলামের ভক্ত নেই। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে তার নিজস্ব বলয় তৈরি হয়েছে। এছাড়া স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন নেতা। রাজনৈতিক জীবনে তিনি অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন।
তবে তার সেই যুগের পর যুগ টিকে থাকা পদ পদবীতে ফাটল ধরে বর্তমান বহাল থাকা দলের উপজেলা কমিটি গঠনের সময়। এবারে তিনি সভাপতি পদে নির্বাচন করে বর্তমান সভাপতি এমএ সালামের কাছে পরাজিত হন। জহুরুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনে এটা ছিল সবচেয়ে বড় আঘাত। সবমিলিয়ে দলের একজন পরীক্ষীত সৈনিক হিসেবে তিনি মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে জহুরুল ইসলাম বলেন, আমি স্কুল জীবন থেকে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত কোনদিন নিস্ক্রিয় হইনি। বিপদ আপদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেতা কর্মিদের আগলে রেখেছি। আন্দোলন সংগ্রামে আমার মত এত কারাবরণ চৌগাছা ঝিকরগাছা উপজেলার কোন নেতা করেনি। আমি বিশ্বাস করি দল এবার আমাকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দিবে।
নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির সভাপতি এমএ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক ও হাকিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল হাসান বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দিবে আমরা তার পক্ষে নির্বাচন করবো।
অপরদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ করেই জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রার্থী পরিবর্তন করেছে। ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জামায়াত নেতা মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদাৎ হুসাইন। তার মৃত্যুর পর দলীয় নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে অধ্যাপক আরশাদুল আলমকে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করে। আরশাদুল আলম দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ মাঠে ময়দানে কাজ করে যাচ্ছিলেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমীর ডাক্তার শফিকুর রহমান লন্ডনে বসবাসকারী বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোসলেহ উদ্দিন ফরিদকে চৌগাছা ঝিকরগাছা আসনের প্রার্থী ঘোষণা করে দেন। ডাক্তার ফরিদ যশোর এমএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শরীফ হোসেনের ছেলে। প্রথমদিকে এলাকার কিছু নেতাকর্মী বিরুপ মন্তব্য করলেও ডাক্তার ফরিদের গণমুখী চরিত্রের কারণে অল্পদিনের ব্যবধানে তিনি নেতাকর্মীদের মনে জায়গা করে নেন। ডাক্তার মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ আগস্ট মাস থেকে চলতি মাস পর্যন্ত চৌগাছা ও ঝিকরগাছা উপজেলায় ২৪ টি ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্প করে অন্তত পঞ্চাশ হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ প্রদান এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন। এছাড়া দুই উপজেলায় জুলাই শহীদ জাবের-আলামীন স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে ফুটবল টুর্ণামেন্টের আয়োজন করে যুব সমাজের আইকন হয়ে গেছেন। সবমিলিয়ে সমাজের তৃণমূল থেকে এলিট পার্সন সবার কাছে ডা. ফরিদ একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিতে পরিনত হয়ে গেছেন। তাছাড়া চৌগাছা ঝিকরগাছা উপজেলায় জামায়াতের রয়েছে বেশ শক্ত অবস্থান। ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের দলীয় প্রার্থী মকবুল হোসেন কাকতালীয় ভাবে বিজয় লাভ করেন। সেখান থেকে শুরু হয় এ আসনে জামায়াতের তৎপরতা। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে কর্মী সমর্থকের সংখ্যা। পরবর্তীতে ২০০১ সালে জামায়াতের মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদাৎ হুসাইন চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর থেকে তরতর করে উপরে উঠতে থাকে জামায়াত। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে জামায়াত আশাবাদী। জানতে চাইলে চৌগাছা উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা গোলাম মোরশেদ বলেন, চৌগাছা ঝিকরগাছা আসনে জামায়াতের রয়েছে শক্ত অবস্থান,তাছাড়া সুখে-দুখে জামায়াত জনগণের পাশে থেকেছে সবসময়। সেকারণে আমরা বিশ্বাস করি জনগণ আমাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।
বিএনপি জামায়াতের বাইরে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ গত ১২ জুন প্রার্থী মনোনয়নের জন্য নেতাকর্মীদের ভোট গ্রহণ করেছে তবে এখন পর্যন্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। খুব দ্রুত প্রার্থী ঘোষণা করা হবে জানিয়েছে একটি সূত্র। এছাড়া এবি পার্টির কেন্দ্রীয় সহকারী প্রচার সম্পাদক রিপন মাহমুদ গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে জামায়াত ছাড়া শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কারা দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন তা দেখার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।