৫ দফা দাবিতে চলমান যুগপৎ আন্দোলনের ২য় দফার ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল রোববার দেশের সকল জেলায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরবার স্বারকলিপি প্রদান করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বিভিন্ন জেলা নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে দুপুর বারোটা থেকে দুপুর দেড়টার মধ্যে একযোগে স্বারকলিপি প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসকগণ সরকারের পক্ষে স্বারকলিপি গ্রহণ করেন।

স্বারকলিপিতে এই সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট ও কার্যক্রম সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে স্মরণ করিয়ে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সফল গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আপনার নেতৃত্বে অর্ন্তর্বতী সরকার গঠিত হয়। অর্ন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রের প্রয়োজনকে সামনে রেখে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও স্বৈরাচার ফিরে আসার সকল পথ রুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করেন। গঠিত হয় বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে আলোচনায় মিলিত হন। দীর্ঘ আলোচনার পর ৮৪টি প্রস্তাব সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। অনেকগুলো প্রস্তাবের সাথে কতিপয় রাজনৈতিক দল ভিন্নমত পোষণ করায় সেগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

জুলাই সনদের বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরাবরই জুলাই জাতীয় সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি' হিসেবে অতীতের বিভিন্ন নজির ও উদাহরণ তুলে ধরে জুলাই জাতীয় সনদের আইনগত ভিত্তির বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর অবস্থান বারবার ব্যক্ত করে আসছে। এ লক্ষ্যে জুলাই জাতীয় সনদের আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সরকারের কাছে লিখিতভাবে দুইটি প্রস্তাব করেছে। প্রথমত: জুলাই জাতীয় সনদের জন্য "সংবিধান আদেশ" জারি করা, দ্বিতীয়ত: এই সনদের অধিকতর আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য নির্বাচনের পূর্বে গণভোট প্রদান করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা। সেটা না হলে জুলাই জাতীয় সনদের আইনগত ভিত্তি প্রদান ব্যতীত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অভ্যুত্থান ও তার অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে বলে আমরা মনে করি।

আসন্ন নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে উৎকন্ঠা জানিয়ে বলা হয়, ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ভয়ভীতিমুক্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে আসছি।

আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ, ভোটকেন্দ্র দখল, পেশিশক্তি প্রদর্শন ও ভোটের বিভিন্ন অনিয়ম ও অপতৎপরতা বন্ধ, কোয়ালিটি-সম্পন্ন পার্লামেন্ট এবং দক্ষ আইনপ্রণেতা তৈরিসহ প্রতিটি ভোট মূল্যায়নের লক্ষ্যে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবির সাথে একমত পোষণ করেছেন।

গণহত্যার বিচার ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়, বিগত সরকার বিভিন্ন স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে সংবিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকরণ করে ধ্বংস করেছে। হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের উপর জুলুম-নির্যাতন, মামলা-হামলা, জেল-জরিমানা, গুম, খুন করে দেশপ্রেমিক কণ্ঠকে স্তমিত করতে চেয়েছে।

দিনের ভোট রাতে নির্বাচনের নামে জাতীর সাথে প্রহসন করেছে। আর এ সমস্ত অবৈধ কার্যক্রমগুলোকে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল শুধু প্রকাশ্যে সমর্থনই দেয় নাই বরং জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাই স্বৈরচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে জনগণ জোর দারি জানিয়ে আসছে।

জনতার দাবীর প্রতি সরকার উদাসীনতা প্রদর্শন করছে মর্মে স্বারকলিপিতে বলা হয়, আমরা লক্ষ্য করছি জনগণের দাবিসমূহ কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এমতাবস্থায় জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে গড়ার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহ দাবি জানিয়ে আসছে। এরই প্রেক্ষিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ সেপ্টেম্বর মাসে ৫-দফা গণদাবি জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে এবং রাজধানীসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলায় সমাবেশ, বিক্ষোভ ও গণসংযোগ করেছে। এ সমস্ত কর্মসূচীতে সারাদেশে বিপুল সংখ্যক জনগণ অংশগ্রহণ করেছে।

স্বারকলিপিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দাবীসমূহ আবারো উপস্থাপন করে তা বাস্তবায়নে তাকিদ দেয়া হয়।

আমরা মনে করি উল্লেখিত দাবিসমূহ বাস্তবায়িত হলে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে যা বাংলাদেশকে একটি অনন্য উচ্চতায় আসীন করবে। তাই আমরা জনগণের পক্ষে উপরোক্ত ৫-দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য আপনার নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।

৫ দফা দাবি আদায়ে তৃতীয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্মমহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় দলের এক জরুরি বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে বলেছেন, ২৪ এর জুলাইয়ে রক্তের নজরানা দিয়ে ছাত্র-জনতা যে দাবীর যথার্থতা প্রমান করেছে সেই দাবীর আইনী ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের রাজপথে লড়াই করতে হচ্ছে; এরচেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কিছু হতে পারে না। তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাত্র-জনতার রক্তের দায় শোধ করতে রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়েই যাবে ইনশাআল্লাহ।

মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ৫ দফা দাবি আদায়ে এর আগেও আমরা দুই দফায় কর্মসূচি পালন করেছি। দ্বিতীয় দফায় ১ অক্টোবর থেকে ৯ অক্টোবর দেশব্যাপী গণসংযোগ, ৯ অক্টোবর বিভাগীয় শহরে গণমিছিল এবং আজকে সারাদেশের সকল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্বারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। কর্মসূচিতে মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশ গ্রহণ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। যারা কষ্ট করে আমাদের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তাদের সকলকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

সরকারের পক্ষ থেকে জনতার যৌক্তিক এসব দাবীর প্রতি ইতিবাচক সংবেদনশীলতা প্রদর্শন না করায় আমরা তৃতীয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছি।

আমাদের দাবীসমূহ হচ্ছে,(১) জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশের মাধ্যমে গণভোট প্রদান করে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করা। (২) আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিকে জুলাই জাতীয় সনদের অন্তর্ভুক্ত করে গণভোট প্রদান করা। (৩) অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। (৪) ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা। (৫) স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।

এসব দাবী আদায়ে আগামী ১৪ অক্টোবর ঢাকাসহ দেশের সকল বিভাগীয় শহরে সকাল ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মানববন্ধন এবং ১৫ অক্টোবর সারাদেশের সকল জেলায় সকাল ১১টা থেকে ১২টা মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। কেন্দ্রীয়, বিভাগীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দসহ সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষ মানববন্ধনে অংশ নেবে।

জরুরি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, যুগ্মমহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, মাওলানা ইমতেয়াজ আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ইফতেখার তারিক, যুব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান মুজাহিদ, আব্দুর রহমান, মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ কাশফি, অধ্যাপক নাছির উদ্দিন, ডাক্তার শহিদুল ইসলাম, মাওলানা আরিফুল ইসলাম, মাওলানা লোকমান হোসাইন জাফরি ও মুফতি হেমায়েতুল্লাহ প্রমুখ।