ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে মাঠে নামার চেষ্টা করছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। দলটির ঘোষিত ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি নিয়েও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। সেইসাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে অবস্থান নেয়। কিন্তু না! আওয়ামী লীগকে রাস্তা কিংবা মাঠে কোথাও দেখা যায় নি। কোথাও মিছিল কিংবা বড় কোন নাশকতার খবরও পাওয়া যায় নি।
বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ এবং ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচির পক্ষে অনলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে উঠেন আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। এরপর থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে, যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালান যে, ওই দিন ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। কিন্তু না! তাও দেখা যায় নি।
এক বছরেরও বেশি সময় আত্মগোপনে থাকা ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আদালতে শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে রাজপথে নামা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান দেওয়া হচ্ছিল। সেইসাথে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় কবে দেওয়া হবে, তা ১৩ নভেম্বর নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেদিনও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। শোনা যায় আওয়ামী লীগের দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এ কর্মসূচি নিয়ে কথা বলছিলেন। দলের সিনিয়র নেতারাও এ বিষয়ে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং কাজ করছেন। কিন্তু এর ফল দেখা যায়নি মাঠ পর্যায়ে।
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত এক বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই এ লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে তা সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ কর্মসূচি সফল করবে। ঢাকাকে পুরো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। এরমধ্যে ১০ নভেম্বর ঢাকায় বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণের কয়েকটি ঘটনা ঘটে। পরদিন ১১ নভেম্বর মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ের সামনেও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোর জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আওয়ামী লীগই এই নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে। পরে দেখা যায় ভাড়াটিয়া কিছু টোকাই দিয়ে এসব করানো হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় সাড়ে ছয় মাস পর হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতারা দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়ানো অবস্থায় এই হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে। তবে হরতালের পক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ গত ৫ আগস্টের পর থেকে রয়েছে ছন্নছাড়া অবস্থায় । দলের নেতাদের অনেকেই পালিয়ে দেশ ছেড়েছেন। যারা দেশে আছেন তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, বাকিরাও প্রকাশ্যে আসার সাহস পাচ্ছেন না।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবার ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। শহীদ নূর হোসেনের পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবিও সঙ্গে নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। শেখ হাসিনা জানান, ট্রাম্পের ছবি নিয়ে মিছিলে বাধা দিলে সেই ছবি যেন ভালো করে তুলে রাখা হয়। তিনি সেই ছবি ট্রাম্পের কাছে পাঠাবেন, কারণ তার ট্রাম্পের সঙ্গে লিঙ্ক আছে। তবে ১০ নভেম্বর জিরো পয়েন্টের কাছেও ভিড়তে পারেনি আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী। দিনভর স্থানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিরোধীদের দখলে ছিল। অনেকে এটাকে জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের জিরো পারফরম্যান্স হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপর ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে অনেকটা চুপসে যায় আওয়ামী লীগ। অনলাইনে গুজব ছড়ানো ছাড়া তাদের কোথাও সক্রিয় দেখা যায়নি।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। সরকার পতনের পর দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত অধিকাংশ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর তিন মাস পরও আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। সেবছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং বিদেশে পলাতক আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অন্য নেতাকর্মীদের দ্বারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধমূলক ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইন-শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগ ওঠে।
গত এক বছরে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাদের সমস্যার খোঁজ নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সারা দেশের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি নিয়েও শেখ হাসিনা দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং তাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা অজ্ঞাত স্থান থেকে জানান, ঢাকা লকডাউন সফল করতে নেতাকর্মীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা ব্যাপক সংখ্যায় রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে তাদের কাউকে রাস্তায় দেখা যায় নি। অবস্থা এমন হয়েছে যে যত গর্জে তত বর্ষে না।