# বহাল তবিয়তে স্বৈরাচারের দোসর কর্মকর্তারা

# সংস্কার শেষ না করেই নির্বাচন চায় কয়েকটি রাজনৈতিক দল

ত্রয়োদশ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। ঘুরে ফিরে কেন্দ্রদখলসহ প্রভাবিত করার চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং বিশ^াসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় সেগুলো এখনো অনেক বাকী রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সামনে আসে বিগত দেড় বছরেও প্রশাসন থেকে স্বৈরাচারের প্রত্যক্ষ দোসরদের বের করে দেওয়া যায়নি। এসব কর্মকর্তারা নানাভাবেই নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। একইসাথে সংস্কার শেষ না করেই যেন তেনভাবে ক্ষমতায় বসে যাওয়ার ধান্ধা করছে কিছু রাজনৈতিক দল। এজন্য দলীয় কর্মকর্তাদের নির্বাচনের কাজে লাগানোর জন্য পছন্দের জায়গাতে বদলি করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যেই। সর্বোপরি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে শর্তগুলো পরিপূরণ করা অপরিহার্য তা ও পূরণ করা যায়নি এখন পর্যন্ত। এরপরও সরকারের পক্ষ থেকে একটি সেরা নির্বাচন দেওয়ার আশ^াস দিয়ে যাচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংস্কার, বিচার এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের কাজে সহায়তা দিতে চাইলেও কয়েকটি রাজনৈতিক দল তা মানতে নারাজ বলে মনে করা হচ্ছে। তারা ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার এবং বিচার করার কথা বলছেন।

সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ত্রয়োদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্মরণকালের সেরা নির্বাচন উপহার দেওয়ার কথা বার বারই বলা হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণে দেশে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও সবার কাছে বিশ^াসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিঘœ তৈরি করে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা আরোহন করতে চায় কোন কোন রাজনৈতিক দল। তবে অন্যপক্ষগুলো দেশের জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় আসতে চায়।

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তাকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন। সম্প্রতি চট্টগ্রামে জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অসুবিধা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় শীর্ষক আলোচনায় সিইসি বলেন, সামনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাদেরকে নিয়োগ করব, কোথায় নিয়োগ করব, পোস্টিং কোথায় দেবো ইত্যাদি। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে যে, ভোট গ্রহণের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপত্তা। এটা বিশাল আকারে দেখা দিয়েছে এবং এটা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। এটা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় বিবেচনায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকাতে কর্মকর্তাদের বদলি করার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। নির্বাচন কমিশনে গিয়ে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কর্মকর্তাদের বদলি করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির পক্ষ থেকে এই অনিয়ম বাদ দিয়ে লটারির মাধ্যমে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে সুপারিশ করা হয়।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন নির্বাচন নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে স্বৈরাচার হাসিনার আমলের বিতর্কিত কর্মকর্তারা প্রশাসনে এখনো বহাল তবিয়তে বসে আছেন। তারা সুযোগ পেলেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকবেন বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। বলা হচ্ছে, নির্বাচন পরিচালনা করার যে সংস্কৃতি দেশে বিরাজমান সেখানে মাঠ প্রশাসনে পুলিশের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ডিসি ছাড়াও তার টিমের এডিসি, ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড। এ অবস্থায় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতদুষ্ট থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকে তাহলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা দুরূহ হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রশাসনের নানা রকম সূক্ষ্ম কারচুপি ও প্রভাব বিস্তারের কারণে ভোটকেন্দ্রে অনাকাক্সিক্ষত অনেক ঘটনা ঘটতে পারে। অথচ ডিসি হিসাবে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সরাসরি তল্পিবাহক হওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কেউ ছিলেন বিগত সরকারের প্রভাবশালী সচিবদের একান্ত সচিব (পিএস)। অর্থাৎ ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। অনেকের নেই মাঠ প্রশাসনে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠায় ইতোমধ্যে নিয়োগ দিয়ে ছয়জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন নিয়ে প্রশাসনে হযবরল অবস্থা চলছে।

এদিকে অবাধ, সুষ্ঠু স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্রাইটিরিয়াগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে-- নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করা, নির্বাচনে সবার জন্য সমানক্ষেত্র নিশ্চিত করা, ভোটারদের হয়রাণিমূক্ত পরিবেশে ভোট প্রদানের সুযোগ করে দেওয়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নির্বাচন প্রক্রিয়া জবাবদিহিমূলক করা এবং আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণ। এক্ষেত্রে টান্সপারেন্সি ইন্টার ন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি কয়েকটি সুপারিশ করেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তথ্য সংগ্রহে অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করা, দেশি বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সুযোগ প্রদান, নির্বাচন প্রক্রিয়া ডিজিটাল করণের পাশাপাশি রাজনৈতিকদলগুলো আর্থিক তথ্য প্রকাশের কথা বলা হয়েছে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায় বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এসব ক্রাইটিরিয়াগুলোর কোনটিই পূরণ করা হয়নি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসে একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা বার বার আশ^স্থ করে বলছেন যে আগামী নির্বাচন হবে জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার এবং শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের পর জাতির কাছে একটি অবাধ- নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গিকার করা হয়। কিন্তু নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই প্রশ্ন আসছে সংস্কারগুলো আদৌও পরিপূর্ণতা পাচ্ছে কি-না। স্বৈরাচারের দোসর কর্মকর্তাদের নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে কি-না। সকল দলের জন্য লেবেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি হচ্ছে কি-না। ভয়হীনভাবে ভোটাররা তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি-না। কেন্দ্রগুলোতে পেশিশক্তিমুক্ত পরিবেশ বজায় থাকবে কি-না। অবাধ তথ্য সংগ্রহের সুযোগ থাকবে কি-না।

এসব সীমাবদ্ধতা সামনে রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের সরকারকে সহায়তার আশ^াস দিলেও দেশের কোন কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাতে আপত্তি করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে সংস্কার কমিটির সুপারিশগুলো ক্ষমতায় আসার পর বাস্তবায়ন করা হবে। দেশের জনগণের পক্ষ থেকে সংস্কার বিচার এবং নির্বাচনের ধারাবাহিকতা রক্ষার দাবি থাকলেও সময়ের ব্যবধানে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও কিছুটা শিথিলতা দেখা যাচ্ছে।

আগামী নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ দেখছেন না জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপিও। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের অভিযোগ, তারা আগে থেকে এটা বলে আসছিলেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে জবর-দখল, প্রশাসনের দখল, টাকার ব্যবহার, কালো টাকার ব্যবহার, পেশিশক্তির ব্যবহার ইত্যাদি সব সময় দেখে এসেছেন, শুনে এসেছেন। ফ্যাসিবাদী সময়ে তো মানুষ ভোট দিতেও যেতে পারেনি। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার ও প্রশাসনের যে শক্ত অবস্থানে থাকা প্রয়োজন, সেটা তাদের কাছে মনে হচ্ছে না। তারা দেখতে পাচ্ছেন, বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন, প্রশাসনকে কীভাবে দখল করতে হবে, প্রশাসনকে কীভাবে হাতে রাখতে হবে।

অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার ঠাকুরগাঁওয়ে আইনজীবীদের সাথে মতবিনিয়ম সভায় বলেছেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্র উত্তরণের পথে যাচ্ছে, সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে, কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের মত আচরণ করে, আমাদের কি আদতেই গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ কোন রাজনৈতিক দল আছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

এক্ষেত্রে আইন সংশোধন করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ সংগ্রহ, আয়ের বৈধ উৎস উল্লেখ করার মতো বিষয়গুলো সামনে আনার পরামর্শ দেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলি। এছাড়া চলমান সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর গুরুত্বারোপ করেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক এই কর্মকর্তা।

সার্বিক বিষয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে রাজনীতি বিশ্লেষক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডক্টর আবু ইউসূফ দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সঙ্গত কারণেই জাতির আশা আকাঙ্খা ছিল সকল লুটতরাজ, খুন,মানবতা বিরোধী অপরাধ টাকা পাচার ও দেশ বিক্রির বিচার। কিন্তু রাজনীতিকে দেশ ও জাতির কল্যানের বদলে ক্ষমতা গ্রহনের সিড়ি বানিয়ে মানি মেকিং মেশিন হিসেবে কাজে লাগানোর বিশ্বাস ও তৎপরতার কারণে বিচার ও সংস্কারের কথার পরিবর্তে বিদেশী প্রভুদের দাসত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য বিচার ও সংস্কারের বিরোধিতা করা হচ্ছে।

প্রথমত বিচার ও সংস্কারের বিরোধিতা করে নির্বাচনের দিকে নেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বর্তমান চাঁদাবাজী ও লুটপাটের সমালোচনাকে আড়াল করা ও বৈধতা দানের চেষ্টা করা। আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য যে আজও আমরা জাতিকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে পারিনি। একই কারণে এ জাতি বারবার ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করায় দলীয় করণের এ ধারা অতীতে যেমন ছিল বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে ও এটা চলবে যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। রাজনীতির স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দানের মাধ্যমে এর পরিবর্তন করতে হবে।