আফাজ্জল হোসেন বাগমারা থেকে : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে মনোনয়ন লড়াইয়ে বিএনপির তৃণমুল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অপর দিকে জামায়াতের একক প্রার্থী সক্রিয় ভাবে মাঠে। বিএনপি ও জামায়াতের তৎপরতায় আসনটি বেশ উত্তপ্ত। এতে বিএনপির থেকে কে মনোনয়ন পাবেন এ নিয়ে চলছে উপজেলার সর্বত্রই জল্পনা-কল্পনা।

এ আসনে বিএনপি’র শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠেছে জামায়াতের একমাত্র নেতা উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর ভবানীগঞ্জ ক্লিনিকের পরিচালক বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: আব্দুল বারী। ডা: আব্দুল বারী চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এই আসনটি জামায়াতের দখলে রইবে এমন প্রত্যাশা করেছেন সংশ্লিষ্ট দলের নেতৃবৃন্দ। ডা: বারি পরিচ্ছন্ন ও উন্নত বাগমারা গড়ার জন্য জমায়াতে ইসলামীর প্রতীক দাঁড়িপাল্লায় তিনি ভোট প্রার্থনা করছেন। পথসভায় সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং সকল বৈষম্য ও হানাহানির অবসান ঘটিয়ে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকার প্রত্যায়ে মাঠে চষে ফিরছেন।

ইতোমধ্যেই বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রস্ততিতে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দলীয় মনোনয়ন নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রায় ডজন খানিক নেতা মনোয়ন প্রত্যাশায় রয়েছেন। এরা হলেন, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল গফুর, বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়া, সদস্য সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জহুরুল আলম বাবু, সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল গফুরের ছেলে মেজর (অবঃ) আব্দুল্লাহ আল ফারাবী, সাবেক ছাত্রদল নেতা আমেরিকা প্রবাসী ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম, রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল, এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সহসম্পাদক ড্যাব নেতা ডা. আশফাকুর রহমান শেলীসহ অন্তত কম পক্ষে আরোও ৫ জন।

রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আগে মোহনপুর ও বাগমারাকে নিয়ে ছিল রাজশাহী-৩ আসন। তবে বিভক্তির পর ২০০৮ সালে নির্বাচনে বাগমারা উপজেলা নিয়েই একটি আসন করা হয়। এ আসনে রয়েছে ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা। ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনটিতে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী মরহুম সরদার আমজাদ হোসেন। সে সময়ে মোহনপুর ও বাগমারাকে নিয়ে ছিল বাগমারা আসন। আসনটি সাবেক বিএনপি’র সংসদ সদস্য মরহুম আফজাল হোসেন সাবেক মন্ত্রী সরদার আমজাদকে হারিয়ে বিএনপির ঘাঁটি তৈরি করেন। পরবর্তিতে এই আসনে সাবেক আ’লীগ নেতা আ’লীগের সমর্থন ও মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিএনপি’র ঘাঁটি হিসেবে দলের নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে ১৯৯৬ বিএনপি’র মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচিত হন সাবেক আমলা আবু হেনা। এ আসনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আবু হেনা এমপি ছিলেন। ২০০৪ সালে বাগমারায় জঙ্গি উত্থানে বাগমারার বিএনপিকে জড়িয়ে অপব্যাখ্যায় তিনি বহিস্কার হন। ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নন নিয়ে রাজশাহী-৩ (বাগমারা-মোহনপুর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচনে অধ্যাপক আব্দুল গফুর বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। একবার নির্বাচিত হলেও পরের বার ২০০৮ সালে অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলে সন্মানজনক ভোটে পরাজিত হন। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী শিল্পপতি প্রকৌশলী এনামুল হক এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সহ টানা তিনবার এমপি ছিলেন। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরিবর্তন করে আবুল কালাম আজাদকে মনোনয়ন দিলে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।

সাবেক এমপি এনামুল হক ও আবুল কালাম বিভিন্ন মামলার আসামি হিসাবে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। দলটির নেতাকর্মীদের কোনো তৎপরতা নেই। ফলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে উপজেলায় প্রধান দুটি দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে লড়াই হবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। এবার এ আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শীর্ষে ৬ জন রয়েছেন। ডিএম জিয়াউর রহমান বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আউসপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাগমারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জিয়াউর রহমান বলেন, নেতাকর্মীদের দুঃসময়ে পাশে থেকেছি। আমি দীর্ঘ সময় জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছি। এসব বিষয় বিবেচনায় হাইকমান্ড আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে তিনি আশাবাদী।

অধ্যাপক কামাল হোসেন বাগমারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব। তিনি ২০১০-এ বাগমারা উপজেলা যুবদলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৬-তে রাজশাহী জেলা যুবদলের এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক হন। ২০১৭-তে জেলা বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক কামাল হোসেন ছাত্র জীবন থেকে বিএনপির রাজনীতি করেন। তিনি ভবানীগঞ্জ কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ২০১৭ সালে কলেজটি জাতীয়করণ হলে তিনি ইস্তেফা দিয়ে দলের কাজে সক্রিয় হন। অধ্যাপক কামাল বলেন, দলের চরম দুঃসময়ে আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়েছি। বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারেক রহমানের নির্দেশে দলের কর্মসূচি পালন করেছি। এ কারণে মামলা ও হামলার শিকার হয়েছিলাম। বাগমারা উপজেলা বিএনপিকে আমি সুসংগঠিত কেেরছি। আশা করছি, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।

সাবেক সংসদ সদ্য অধ্যাপক আব্দুল গফুর বলেন, দুর্দিনে বিএনপি’ সাথে ছিলাম। ’৯৬-এর স্বল্প সময়ে এমপি হয়ে সাধ্যমতো জনগণের সেবা ও এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছি। দীর্ঘ ৮ বছর উপজেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। দীর্ঘ ১৫ বছর ফ্যাসিবাদ আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। আমি ও আমার সন্তান মেজর (অব.) ফারাবি কোন টাকা পয়সার লোভে এমপি’র নির্বাচন করছি না। দুর্নীর্তিমুক্ত বাগমারাকে গঠন করবো ইনশাল্লাহ, এটাই উদ্দেশ্য। আমাদের কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। তার আরেক ছেলে বিশিষ্ট অর্থোপেডিক সার্জন ডাক্তার ফকরুল ইসলাম (!) তিনি বাগমারাবাসীর নাম করলে বিনা টাকায় চিকিৎসা সেবা দেন। বাগমারাবাসীর সেবা করাই আমাদের মুল লক্ষ্য।’ পিতা ও পুত্র দুই জনই মনোনয়ন চাইবেন এতে দল যাকে দিবেন তাতেই তিনি খুশি বলে জানান তিনি। একই ভাবে পুত্র মেজর (অব.) ফারাবি বলেন, বিএনপি একটি মধ্যপন্থি দল হওয়ায় এ দলকে পিতার ন্যায় হৃদয়ে লালন করি। আ’লীগের আমলে বিএনপির পরিবারের সন্তান হওয়ায় তাকে রোষানলে কঠিন গ্লানি সইতে হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রথম সারির একজন অফিসার হওয়া সত্বেও বিগত আ’লীগ সরকার বিএনপির এমপির সন্তান হওয়ায় প্রমোশন বঞ্জিত করে এবং পরবর্তিতে নির্যাতনে চাকরি শেষ হওয়ার পুর্বেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে তাকে। রেজাউল করিম টুটুলের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ২০০০ সালে ছাত্রদলের মাধ্যমে। ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিনি টানা ৫ বছর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ২০২১ থেকে রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব। রেজাউল করিম টুটুল বলেন, আমি দীর্ঘদিন থেকে বাগমারায় রাজনীতি করছি। বাগমারা বিএনপি’র র্দুদিনে আমি নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছি। এক সময়ে বাগমারায় বিএনপির রাজনীতিতে কিছুটা নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে কাজ করি বা করছি। আর নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার জায়গা থেকেই দলের হাইকমান্ডের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জহুরুল আলম বাবু বাগমারা উপজেলার বাগমারা গ্রামের মুক্তি যুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত নুরুল ইসলাম মাস্টারের সন্তান। ২০১০ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বিএনপি’র রাজনীতিতে সরাসরি যোগ দিয়ে দলের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সেনাবাহিনীতে কমরত অবস্থায় তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। মনোনয়ন প্রত্যাশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দল যদি দায়িত্ব দেয়, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে রাষ্ট্র মেরামতে বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নে কাজ করব। এর আগে ২০১৮ সালেও তিনি বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এবারে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। দলের অপর জন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমেরিকা প্রবাসী ডা. জাহিদ দেওয়ান শামীম তিনি দলের কাজ করছেন দীর্ঘ দিন। তার প্রত্যাশা এবারে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়া দলের হাই কমান্ডের ইঙ্গিতে ড. আশফাকুর রহমান সিনিয়র বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে মাঠে রয়েছেন বলে তাদের সমর্থকরা প্রচার চালাচ্ছেন।