দেশের চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে লিখিত পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের পক্ষ থেকে সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ পরামর্শপত্র হস্তান্তর করেন। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টাকে সম্বোধন করে ওই পত্রে বলা হয়, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী রক্তঝরা আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়। গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বৈষম্যহীন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশের জনগণ অপেক্ষমান।

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের উসকানিমূলক আচরণ, জুলাই আগস্টের রক্তক্ষয়ী ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে অশালীন এবং আপত্তিকর বক্তব্য-মন্তব্য দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে অতি সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত স্বৈরাচারের স্মৃতি, মূর্তি, স্থাপনা ও নামফলকগুলো ভেঙে ফেলার মতো জনস্পৃহা দৃশ্যমান হয়েছে।

পতিত ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা করে যাচ্ছে। প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের সহায়তায় দেশের বাইরে থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এই তৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছেন। সুতরাং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা দরকার।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ছয় মাসেও পলাতক স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ জনসম্মুখে দৃশ্যমান করতে সফল হয়নি বলে জনমনে প্রতিভাত হয়েছে। ফলে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো বেআইনি কর্মকা-ে উৎসাহিত হচ্ছে। একটি সরকার বহাল থাকা অবস্থায় জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হতে পারে।

অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ছিল দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, যা বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।

বিরাজমান অস্থিতিশীল রাষ্ট্র পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিনিয়োগ-বাণিজ্যে স্থবিরতা ও বাজার সরবরাহ ব্যবস্থায় নৈরাজ্যপনা ইত্যাদি সীমাহীন জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের দাবিনামা নিয়ে মব কালচারের মাধ্যমে সীমাহীন জনদুর্ভোগ, সড়কে উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে মুন্সিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এক ধরনের সামাজিক নৈরাজ্যের বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থানের জনআকাক্সক্ষা ম্রিয়মান হতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতির উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের সার্বিক আকাক্সক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সার্বিক গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

নির্বাচিত সরকার না থাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের গতি স্থবির হয়ে পড়েছে। কেননা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী দেশসহ বিশ্বের অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়ন সংক্রান্ত অর্থনৈতিক চুক্তি করতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। তাদের সঙ্গে কোনো দেশ বা সংস্থা কোনো প্রকার সহযোগিতা চুক্তিতে আসতে আস্থা পায় না। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেশ পিছিয়ে পড়ছে।

গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত এবং বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার প্রস্তাবগুলোর সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি প্রদানের জন্য একটি নির্বাচিত সংসদই শুধু উপযুক্ত ফোরাম।

নির্বাচনমুখী জরুরি সংস্কার সাধন করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করাই বর্তমান সরকারের প্রধানতম ম্যান্ডেট। এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে, নির্বাচনমুখী অতি আবশ্যকীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের পছন্দের একটি দক্ষ, শক্তিশালী ও কার্যকর সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একই সঙ্গে চলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘ঈযধৎঃবৎ ড়ভ জবভড়ৎসং’ তৈরি হতেই পারে, নির্বাচিত সরকার পরবর্তীকালে যা বাস্তবায়ন করবে। তাই, আমরা অবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই জনআকাক্সক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে।

বিদ্যমান ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য এই দেশ এবং দেশের মানুষের মূল চালিকাশক্তি। এই ঐক্য বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখতে হবে। কোনো মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়ে জাতীয় সংসদের মতোই স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেই কারচুপি ও অনাচারের আশ্রয় নিয়ে পতিত স্বৈরাচার দলীয় লোকদের বিজয়ী করেছে। অবিলম্বে সিটি করপোরেশন ও উপজেলার মতো ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা বিজয়ের জন্যই জরুরি।

সচিবালয় থেকে শুরু করে সারাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের একটি কুচক্রিমহল ‘যোগ্য ও অভিজ্ঞ’ বলে বহাল রাখার অপচেষ্টায় রত। অথচ এসব তথাকথিত যোগ্য ও অভিজ্ঞদের যোগ্যতা ছিল ফ্যাসিবাদের তোষণ করা ও নির্বিবাদে অন্যায় আদেশ পালন করা এবং অভিজ্ঞতা হলো অপশাসন ও দুর্নীতি-অনাচার সহায়তার মাধ্যমে নিজেরাও ক্ষমতা ও দুর্নীতির অংশীদার হওয়া।

অতি শিগগির এদের অপসারণ করা না হলে নিজ স্বার্থেই এরা পতিত ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন ও পুর্নবাসনে সহযোগিতা করে দীর্ঘ ১৬ বছর এবং বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের শহীদদের আত্মদানকে ব্যর্থ করে দেবে। সম্ভাব্য বিপর্যয় রোধে এদের বিরুদ্ধে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা কার্যকর করার আহ্বান জানাচ্ছি। অতি সম্প্রতি বিগত ফ্যাসিবাদের সময়ে পদোন্নতি বঞ্চিত ও অকাল অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে তাদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পদে পদায়ন করা যেতে পারে।

বিতর্কিত ও স্বৈরাচারের দোসরদের অনেককে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরও দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকায় স্বৈরাচারের দোসর এসব ডিসিরা আওয়ামী দোসরদের গোপনে অনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা কিছুই নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের রাতের ভোট, ভোটারবিহীন ভোট, ডামি ভোট অনুষ্ঠানকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্টো তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা এখনো তাদের সাবেক প্রভুদের ইশারায়-ইঙ্গিতে কাজ করে যাচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছে মর্মে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যথাযথ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে কোনো দলের আত্মপ্রকাশকে আমরা স্বাগত জানাবো।

ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে যুক্ত দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে পতিত স্বৈরাচারী সরকার যেসব মিথ্যা, বানোয়াট ও গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে তা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ বিধায় ক্ষতি ও হয়রানির শিকার নিরপরাধ মানুষদের আশ্বস্ত করার জন্য আমরা সরকারকে সব মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে মর্মে একটা ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি।

অধঃস্তন আদালতে গায়েবি মামলায় রাতের বেলায় কোর্ট বসিয়ে যেসব বিচারকরা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সাজা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের বিচার ব্যবস্থায় বহাল রেখে স্বাধীন বিচার বিভাগ বাস্তবায়ন করা জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে।

পরিশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুন, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করুন, দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ দিন, প্রশাসনের সর্বস্তর পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করুন। আপনার এবং আপনার সরকারের প্রতি আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।