২৩ মে দেশব্যাপী বিক্ষোভ

শেখ হাসিনা টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তা না করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনকে কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী আখ্যায়িত করে এ ধরনের কোনো আইন বা নীতি বাস্তবায়ন না করতে সরকারকে সতর্ক করেছেন তারা। অন্যথায় সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হেফাজত নেতারা। অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, নারী কমিশন পুনর্গঠন করা, সংবিধানে আল্লাহর ওপর পুনঃবিশ্বাস স্থাপন ও বহুত্ববাদ বাতিল করা ও রাখাইনে করিডোর দেওয়া থেকে বিরত থাকাসহ ১২ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চার দফা দাবিতে আয়োজিত মহাসমাবেশে হেফাজত নেতারা এসব কথা বলেন। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কুরআন-সুন্নাহবিরোধী প্রতিবেদনসহ কমিশন বাতিল, সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, ফ্যাসিবাদের আমলে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, শাপলা চত্বরে গণহত্যাসহ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম গণহত্যা-নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে ঢাকায় এই মহাসমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনের সভাপতি আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে দেশের প্রায় সব শীর্ষ আলেমই উপস্থিত ছিলেন এই মহাসমাবেশে।

সকাল ৯টা থেকে মহাসমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও ভোর থেকেই জনতার ঢল নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। লাখো মানুষ জড়ো হন সেখানে। এতে কানায় কানায় ভরে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

মহাসমাবেশের শেষের দিকে সংগঠনটির নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণাসহ ১২ দফা দাবি জানায় হেফাজতে ইসলাম। এদিকে ১২ দফা দাবিতে আগামী ২৩ মে সারাদেশে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

মহাসমাবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে হেফাজত নেতারা বলেন, শেখ হাসিনার মতো ভুল করবেন না। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো নীতি বাস্তবায়ন করার সাহস করবেন না। অবিলম্বে প্রতিবেদনসহ নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল ঘোষণা করুন। শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করুন।

বক্তারা বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করবে না। বক্তারা আরও বলেন, আপনারা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য কমিশন করেছেন, জুলাই আন্দোলনের গণহত্যার জন্য কমিশন করেছেন, ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন, কিন্তু মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য কেন তদন্ত কমিশন গঠন করলেন না?

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করা হলেও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এসব মামলা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সম্পর্কে সমালোচনা করে হেফাজতে ইসলামের নেতারা বলেন, সরকার নারীবিষয়ক যে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন এর সদস্যরা নারী না পুরুষ তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। তাদের সংস্কার প্রতিবেদন যদি পাস করা হয় তাহলে জীবন দিয়ে রুখে দেওয়া হবে। মার্চ টু ঢাকার কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবে হেফাজতে ইসলাম।

দাবি পেশকালে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গণহত্যাসহ জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া ৮৪ জন মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষককে স্মরণ করেন। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণকারীদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।

হেফাজতের ১২ দফা দাবির মধ্যে যা আছে

১. নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তাদের কুরআন বিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিলপূর্বক আলেম-ওলামাদের পরামর্শক্রমে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারী সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। নারীর সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা মূল্যবোধ নয়, বরং আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকেই বাস্তবমুখী সংস্কারের দিকে যেতে হবে।

২. সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে হবে। ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ঈমান ও আমল রক্ষার্থে বহুত্ববাদ নামক আত্মঘাতী ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। এছাড়া লিঙ্গ পরিচয়, লিঙ্গ বৈচিত্র্য, লিঙ্গ সমতা, তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে, কাউকে বাদ দিয়ে নয় এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগানের অন্তরালে এবং অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শব্দের আড়ালে এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজবিধ্বংসী ধর্মবিরুদ্ধ সমকামীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে।

৩. শাপলা চত্বর ও জুলাই গণহত্যার বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা ও তার চিহ্নিত দোসরদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

৪. গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে।

৫. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর নামে কটূক্তিকারী ও বিষোদ্গার বন্ধে কঠোর আইন করতে হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ধর্মীয় অবমাননা সংক্রান্ত শাস্তির আইনি ধারাগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ বাতিল করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।

৬. চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শহীদ সাইফুল ইসলাম হত্যার উসকানিদাতা চিন্ময় দাসের জামিন প্রত্যাহারপূর্বক তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে।

৭. ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে প্রতিবাদী আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ইসলামমনা তরুণদের বিরুদ্ধে হওয়া মিথ্যা ও বানোয়াট সব মামলা অতিসত্বর প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তি করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। সেই সঙ্গে জঙ্গী নাটক বা জঙ্গী কার্ড খেলে বাংলাদেশকে ইসলামপন্থী ও আলেম-ওলামাদের গত ১৫ বছর যারা নির্যাতন চালিয়েছিল তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

৮. গাজার মুসলমানদের ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের চলমান গণহত্যা ও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদে আমাদের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই সরকারকে কূটনৈতিকভাবে আরও উচ্চকণ্ঠ হতে হবে এবং দেশের সর্বস্তরের জনতাকে ইসরাইলী ও ভারতীয় পণ্য বয়কট করতে হবে।

৯. ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্ব পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

১০. রাখাইনকে মানবিক করিডোর প্রদানে সরকারের সম্মত হওয়া সম্পূর্ণরূপে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তার স্বার্থে এ অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে অবশ্যই অনতিবিলম্বে ফিরে আসতে হবে।

১১. চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশী মিশনারি অপতৎপরতা ও দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও নিরাপত্তা সংকট কমাতে আলেম সমাজের দাওয়াতী কার্যক্রমকে আরও নিরাপদ ও সুযোগ করে দিতে হবে। সেখানে সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বৃদ্ধি করা ছাড়াও পাহাড়ি ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্থিতিশীলতা বিনির্মাণে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে।

১২. কাদিয়ানীদের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সাধারণ মুসলমানদের ঈমান আকিদা রক্ষার্থে কাদিয়ানীদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।

হেফাজত আমিরের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরী বলেছেন, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনও আইন মেনে নেওয়া হবে না। নারী সংস্কার কমিশন ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম নারীদের অধিকার ও মূল্যবোধের পক্ষে।

হেফাজত আমিরের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, আরাকান সীমান্তে করিডোর দিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকি ও যুদ্ধক্ষেত্র বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি এ ব্যাপারে জনগণের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানান।

তিনি অভিযোগ করেন, নারী সংস্কার কমিশন দেশের পরিবার প্রথা ভেঙে ফেলার চক্রান্ত করছে। তিনি রাসূল (সা.) এর নামে বিরূপ মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দাবি করেন।

হেফাজত আমির বলেন, ভারতীয় ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী দালালদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশে কোনও ফাসিস্টদের ঠাঁই হবে না। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

বাবুনগরী বলেন, গত ১৫ বছর দেশের মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। শাপলা চত্বর ও মোদিবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন তিনি।

দিল্লীর দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি ওয়াশিংটনের গোলামি করার জন্য নয়: মামুনুল হক

দিল্লীর দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি ওয়াশিংটনের গোলামি করার জন্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে মামুনুল হক বলেন, মনে রাখবেন, একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধারা বলেছিল, আমরা পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লীর দাসত্ব করার জন্য নয়। চব্বিশের জুলাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর আমি বলতে চাই, আমরা দিল্লীর দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি, নিউইউর্কের গোলামি করার জন্য নয়। যদি বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনের দাসে পরিণত করার কোন চক্রান্ত করা হয়, হিউম্যানিটরিয়ান করিডোরের নামে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হরণ করার জন্য অপতৎপরতা চালানো হয়, তাহলে সারা দেশের মানুষের প্রতি আমার আহ্বান, যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও, দেশের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও।

তিনি আরো বলেন, বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে চাই, নারী সংস্কারের নামে আল্লাহর কুরআনকে, ইসলামকে কটাক্ষ করা হয়েছে। ধর্মীয় উত্তরাধিকার বিধান, পারিবারিক বিধানকে নারী-পুরুষের বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী বিষয়ক কমিশন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে আমরা রাষ্ট্রের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখতে চাই। হেফাজতে ইসলাম বলতে চায়, এই তথাকথিত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী, বিতর্কিত নারীবাদীদের আদর্শ ও দর্শন নয় বরং হেফাজতে ইসলাম আল্লাহ ঘোষিত নারীর ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাসী।

তিনি আরো বলেন, আমরা পরিষ্কারভাবে বলি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মাথায় এসে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম চলাকালে বহুত্ববাদের মতো বিতর্কিত, একত্ববাদ বিরোধী কোনো ধারণা বাংলার মানুষ গ্রহণ করবে না। আমরা সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস পুনর্বহালের দাবি করেছি। এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য আগামী দিনে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে হেফাজতে ইসলাম সেই সিদ্ধান্তই নেবে, ইনশাআল্লাহ।

তিনি আরো বলেন, আমরা পরিষ্কার করে বলি, ড. ইউনূসের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেকবার সাক্ষাৎ করে বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করেছে, আমাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আমলে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করেন। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। প্রফেসর ড. ইউনূস আপনি কি সেই কথা ভুলে গিয়েছেন, এই দুইমাস আগেও আমাদের সামনে আদালতের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে যদি হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের নামে মামলা প্রত্যাহার না হয় তাহলে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের যা করতে হয় তাই করবে।

হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করুন: মাহমুদুর রহমান

২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করার আহ্বান জানিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, আজকে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি শাপলা চত্বরে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। একই সঙ্গে আমি জুলাই বিপ্লবের শহীদদেরও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে গণহত্যার পর এই প্রথম স্বাধীনভাবে কোনো প্রোগ্রাম করতে পেরেছি।

মাহমুদুর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আমি একটা বিষয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি, হেফাজতের পক্ষ থেকে কেন এতদিনেও সেই দানব ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় নাই। আপনারা কেন এখনো মামলা দায়ের করেন নাই, আমি জানি না। আমি মনে করি, শাপলা চত্বরে যতজন নিহত হয়েছেন, তাদের সবার হয়ে গণহত্যার দায়ে হাসিনার নামে মামলা করতে হবে। এটাই আমার প্রথম দাবি। দ্বিতীয় দাবি, বিশ্বের মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা। তিনি বলেন, আমরা যেহেতু মুসলমান, তাই গাজা ও ভারতের কাশ্মীরের মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালাতে হবে।

নারীবাদের ইস্যু নিয়ে ড. ইউনূস সরকারের সমালোচনা করে মাহমুদুর রহমান বলেন, হেফাজত ইসলাম নারীবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ড. ইউনূস সরকারের প্রতি আমার প্রশ্ন, আপনারা কেন অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করছেন? আমি বলতে চাই, নারী কমিশন তৈরির জন্য জুলাই বিপ্লবের কেউ জীবন দেয় নাই। তারা জীবন দিয়েছিল এদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করার জন্য। কাজেই আপনারা সরকারে বসেছেন যাতে বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে।

আলেম-ওলামাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, আলেম-ওলামাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নারীবাদ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন থেকে সরে যাবেন না। আমাদের বৃহত্তর লড়াই ভারতের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের বৃহত্তর লড়াই ইসলামের জন্য। তাই আপনারা এ ছোট বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করবেন ঠিকই, কিন্তু এর পেছনে বেশি সময় দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন থেকে পিছিয়ে যাবেন না। এজন্য আপনাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা একটু ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের আলেমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকেন, তাহলে দেশের স্বাধীনতা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।

আওয়ামী লীগ মারা গেছে বাংলাদেশে, জানাযা হয়েছে দিল্লীতে : হাসনাত আব্দুল্লাহ

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, আওয়ামী লীগ মারা গেছে বাংলাদেশে, জানাযা হয়েছে দিল্লীতে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে ৫ আগস্ট জনগণ লালকার্ড দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন মেনে নেওয়া হবে না।

তিনি আরও বলেন, শহীদদের রক্তের ওপর পারা দিয়ে এই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আসবে না। এই সংস্কার আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সংস্কার। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সমাবেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। শেখ মুজিব বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। ৩০ হাজার জাসদকর্মীকে হত্যা করেছিলেন।

তিনি বলেন, যারা বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতকর্মীদের টেনে রাস্তায় নামিয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগের আর পুনর্বাসন হবে না। কিন্তু আট মাস পরে এসেও অনেক রাজনীতিবিদ আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেন আওয়ামী লীগ নাকি রাজনৈতিক দল। দলটিকে নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, আপনি ভুলে যাবেন না, আমরা আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছি।

সমাবেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত কিছুদিন আগে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে কি, করবে না সেই সিদ্ধান্ত নাকি আওয়ামী লীগের। আপনি ভুলে যাবেন না, আমরা আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে কি, করবে না, নির্বাচনে আসবে কি, আসবে না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।

তিনি আরো বলেন, আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতার আট মাস পরে যেসব দাবিতে আজ আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি, সেটা আমাদের জন্য গর্বের কিছু নয়, বরং এটি আমাদের জন্য লজ্জার। ৫ আগস্ট সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে, হাসিনার পুনর্বাসনের প্রতি সারা বাংলাদেশের মানুষ রেড কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে। ৫ আগস্ট আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, এই ভূখণ্ডে আওয়ামী লীগের আর পুনর্বাসন হবে না। যেই আওয়ামী লীগ আমাদের দাড়ি-টুপিওয়ালা ভাইদেরকে বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে রাস্তায় নামিয়ে এনে হত্যা করেছিল, সেই আওয়ামী লীগের আর পুনর্বাসন হবে না। নারী কমিশনের ইসলামবিরোধী ধারাগুলো বাতিলেরও আহ্বান জানান হাসনাত।

২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে চলা হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি তুলে এনসিপির মুখ্য সংগঠক বলেন, ‘শহীদদের পরিবারকে নাম প্রকাশের আহ্বান জানাচ্ছি। ’

মহাসমাবেশে হেফাজতের আমির মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন- আলোচিত ইসলামী বক্তা ও জৌনপুরের পীর মুফতি ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। হেফাজত নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- নায়েবে আমির মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, ড. আহমদ আবদুল কাদের, মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী, মুফতি জসীম উদ্দিন, মাওলানা আব্দুল আউয়াল, সরোয়ার কামাল আজিজি, মহিউদ্দিন রাব্বানী, আহমেদ আলী কাসেমী, মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমী, মাহবুব জাকারিয়া, মাওলানা আব্দুল কাদের, মাওলানা আইউব বাবুনগরী, মাওলানা আফজালুর রহমান। যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মাওলানা মামুনুল হক, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, জুনায়েদ আল হাবিব, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবী, হাসান জামিল, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, ইসলামী বক্তা মুফতি রেজাউল করিম আবরার, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মুফতি মনির হোসেন কাসেমী, চরমোনাই পীরের সাহেবজাদা সৈয়দ ইসহাক মোহাম্মদ আবুল খায়ের, মুফতি খলিলুর রহমান নেছারাবাদী ও মধুপুরের পীর মাওলানা আব্দুল হামিদ প্রমুখ।

দুই দফা কর্মসূচি ঘোষণা : মহাসমাবেশের শেষ পর্যায়ে দুই দফা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান। (এক) আগামী ২৩ মে ৪ দফা দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ। (দুই) নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ।