সম্প্রতি ঢাকার মিটফোর্ডে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী লালচাঁদ সোহাগকে মাথা থেঁতলে হত্যার ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধানী কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। গতকাল সোমবার সকালে গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একথা জানান। তিনি বলেন, নৃশংস এই হত্যাকান্ডের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানের জন্য আমরা উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি ‘তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধানী কমিটি’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা প্রকৃত সত্য উদঘাটন করবেন এবং তা জনসম্মক্ষে প্রকাশ করবেন। এ বিষয় নিয়ে যারা রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট এবং জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত করতে চান এবং প্রকারান্তরে ফ্যাসীবাদ উত্থানের পথ কারা সৃষ্টি করতে চান, তাদেরকে চিহ্নিত করা ও প্রতিহত করার প্রত্যয়ও একইসাথে উচ্চারণ করতে চাই।

অপরাধীর বিষয়ে দলের কঠোর অবস্থান পূণর্ব্যক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, অপরাধীর কোনো দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না। ব্যক্তির অপরাধের সাথে দলের কোনো সম্পর্ক নাই।

সকাল সাড়ে ১১টায় গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে জরুরী সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন বিএনপি মহাসচিব।

মিডফোর্ড এলাকায় লালচাঁদ সোহাগ হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচারের দাবি জানানোর পরও নৃশংস এই হত্যার সাথে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের এখন পর্যন্ত গ্রেফতার না করা এবং তাদের নাম-পরিচয় উৎঘাটন করতে না পারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, একটি বিবেকবান রাজনৈতিক দল হিসেবে লালচাঁদ সোহাগ হত্যাকাণ্ডে বিএনপি তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও দৃষ্টামূলক শাস্তি দাবি করছে। এই হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা বা উপস্থিতির প্রমাণ না থাকা স্বত্ত্বেও ঘটনার সাথে জড়িত বলে যাদের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলার আলোকে আজীবন বহিস্কারের মতো সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরূপ দৃঢ দলীয় অবস্থান থাকা স্বত্ত্বেও একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পতিভাবে আমাদের দল এবং র্শীষ নেতৃত্বের (তারেক রহমান) শালীনতা ও চরিত্রহননের দুঃসাহস প্রর্দশন করছে।

সার্বিক বিবেচনায় আমাদের বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করছি, কারণ বিষয়গুলো জনমনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করেছে’ বলে তা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

# এই হত্যাকান্ডের ঘটনা কোনো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার হচ্ছে কিনা এবং এর মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করার জন্য বিশেষ কোনো মহলের প্ররোচনায় এই ধরনের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

# কুমিল্লার মুরাদনগরে সংঘটিত তিনটি নৃশংস হত্যাকান্ড, কুমিল্লার এক মসজিদের ইমামের ওপর নৃশংসভাবে হামলা, খুলনায় যুবদল নেতা মাহবুব মোল্লাকে হত্যা ও রগকাটা, এমন হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে সকলের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সমমানের ছিলো কিনা সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে।

# পরিকল্পিভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

# প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য মানুষের সামনে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নিকটবর্তী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও এরূপ ঘটনার কোনো প্রতিরোধ না হওয়ায় পুরো ঘটনাটি সম্পর্কে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেকের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

# জনসম্মুখে এই রূপ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে ছাড়া বিনা বাঁধায় ভিডিও ধারণ যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।

# পুলিশের বক্তব্য থেকে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে কোনো তথ্য উদঘাটিত হয়নি।

# মাত্র গুটিকয়েক সন্ত্রাসী দ্বারা প্রকাশ্যে এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় মাত্র এক বছর আগে সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীতে পুনরায় আইনের শাসন ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলে বিবেচিত হতেই পারে।

# সরকার পরিচালনার দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ একটি রাজনতৈকি দল ও তার প্রধান নেতৃত্বকে দায়ী করে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন এবং অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আবারও সেই ফ্যাসীবাদের যুগে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।

# দেশে সুস্থধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার গণআকাংখার বিপরীতে পরিকল্পিত অপপ্রচার, অশ্লীল স্লোগানের মাধ্যমে আবারো ফ্যাসস্টি হাসনিা ও আওয়ামী লীগের কণ্ঠস্বরের প্রতিধব্বনিই শোনা যাচ্ছে।

# পূর্বপরিকল্পিতভাবে ৯ জুলাইয়ের ঘটনা ১১ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজের পর, সবচেয়ে প্রাইম টাইমে ইন্টারনেটে ছড়ানো শুরু হয়।

# পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সোশ্যাল মিডিয়া আইডি ও পেজ থেকে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা ফটো কার্ডগুলো অনলাইনে ছড়ানো শুরু হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অনলাইনে ভূয়া তথ্য প্রচাররে ক্যাস্পেইন শুরুর আগে থেকেই অপপ্রচার সামগ্রি তৈরি করে রাখা হয়েছিলো।

# অপরাধীর জন্য কোনো অনুকম্পার সুযোগ যেমন নেই তেমনি পক্ষ অবলম্বনের প্রশ্নই উঠে না। শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে দলীয় পদ থেকে অপসারনের এমন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপকে স্বাগত না জানিয়ে পরিকল্পিতভাবে চরিত্রহনন দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের আইনী সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার থেকে আমাদের বিচ্যুত হবার সুযোগ নেই। নিহত সোহাগের রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং তিনি দেশের একজন নাগরিক, যিনি সন্ত্রাসের নির্মম শিকার। ফলে তার পরিবারের সাথে আমরাও এই অপর্কমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি।

হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত র্কাযকর করার বিষয়ে আমাদের দলীয় অবস্থান সুদৃঢ় এবং অপরিবর্তিত।

মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ আজ উন্মোচিত। এই অপরাজনীতি প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতার প্রতি আমরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা দৃঢভাবে আশা করি দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবণতির ভয়াবহ পরিনাম সম্পর্কে দায়িত্বশীল সকল রাজনৈতিক দল সচেতন হবেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত এই জাতীয় কর্মকান্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত হলে তার দায় সংশ্লিষ্টদেরই বহন করতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা গভীর শঙ্কার সাথে লক্ষ্য করছি সুপরকিল্পতিভাবে এই অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন এই দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের সমার্থক রাজনৈতিক দল ও তার শীর্ষ নেতৃত্ব। গুটিকয়েক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীর অপচেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে না। যে তারুণ্য ফ্যাসীবাদের পতনে আমাদের সাথে অগ্রসৈনিক ছিলেন, আজ দেশের প্রয়োজনে তাদের সাথে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো অপচেষ্টাই আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হতে পারবে না।

মির্জা ফখরুল বলেন, সংঘাত সৃষ্টির পরিকল্পিত ফাঁদে পা না দিয়ে ফ্যাসীবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করার যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। ফ্যাসীবাদের অনুপ্রবেশের যে কোনো ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র আমরা এই বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হতে দেবো না। সকল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে সাথে নিয়ে এদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্পে আমরা বরাবরের মতই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। পতিত স্বৈরাচার আর কাপুরুষ ষড়যন্ত্রকারীদের মিলিত অপচেষ্টা, সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আগামীর বাংলাদেশ গড়ার পথে যদি কোনো বাঁধা হয়ে আসে তবে সেটা আমরা ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে প্রতিহত করবো, ইনশাআল্লাহ।

ফ্যাসীবাদের শাসনের পতনে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, আমরা কুন্ঠিত হই, যখন লক্ষ্য করি বিকৃত রুচির এই বিকারগ্রস্থ গোষ্ঠি তাদের অম্লীল-কদর্য মানসকিতা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কন্ঠে প্রতধ্বিনিত করিয়ে আমাদের প্রজন্মের মূল্যবোধ ধ্বংস করছে শুধুমাত্র তাদের কুৎসতি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে। শতবাধা অতিক্রম করে জনগণকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের মালিকানা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ফেরত দেয়াই আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার। বিগত ১৭ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের কষ্টার্জিত সফলতা ব্যর্থ করার সুযোগ নেই।

সাংবাদিক সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, সালাহ উদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।